ছবিঃ উকিমিডিয়া |
এ গল্প ১৯৮১ সালের ২০ মে স্পেনের মন্তোলেসে, বাবা জোর্সে লুইস আর মা মারিয়া ডেল কার্মেনের কোলজুড়ে জন্ম নেওয়া ফার্নান্দেজের। চিনতে পারেন নি? সেই ছেলেটি লোকে যাকে ইকার ক্যাসিয়াস নামে চেনে। ৭ বছরের বড় ভাই উইনি ক্যাসিয়াস ছিলেন বার্সা ভক্ত। তাই দুই ভাইয়ের মধ্যে বার্সা-রিয়াল নিয়ে সকাল-সন্ধ্যা তর্ক-বিতর্ক লেগেই থাকতো।
বাবা-মা আর বড় ভাই উইনির সাথে থাকতেন স্পেনের মন্তোলেসে। বড় ভাই উইনি মিডফিল্ডার হিসাবে খেলতেন স্থানীয় ক্লাব সিডি মন্তোলেসের হয়। আর বালক বয়সের ইকার বন্ধুদের সাথে খেলতেন যেকোন অবস্থানেই। তারপর একদিন হঠাৎ করে বাবার কথায় গোলকিপারের পজিশনে গিয়ে দাড়ান। বিস্ময়করভাবে ঠেকিয়ে দেন প্রতিটা শট। সেখান থেকে শুরু হয় গোলকিপার হিসাবে ইকারের যাত্রা। বাবা মিনিস্ট্রি অব এডুকেশনে চাকুরী করায় অর্থনৈতিক দূর্দশা ছিল না ক্যাসিয়াসের পরিবারে। তবে বাবা জোর্সে লুইস এর ম্যাচ প্রেডিকশনের নেশা ছিল। প্রেডিকশন লেখার দায়িত্ব ছিল পুত্র ইকারের। একবার তো এক সপ্তাহে ১৪ টা ম্যাচের প্রেডিকশন সঠিক লিখেছিলেন। আবার তারই সামান্য ভুলে তার পরিবারকে হারাতে হয়েছিলো ১.২ মিলিয়ন ইউরো।
দিন যত পার হচ্ছিলো তার মধ্যে অনন্য গোলকিপার সত্তার বহিপ্রকাশ হচ্ছিলো। সেসূত্রে পিতার পরামর্শে ১৯৯০-৯১ মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের যুবদল "লা ফ্যাব্রিকা" তে নাম লেখান।
রিয়াল মাদ্রিদ (১৯৯০-২০১৫)
১৯৯০ থেকে ৯৮ পর্যন্ত ইকার রিয়াল মাদ্রিদের যুব দলের প্রতিনিধিত্ব করেন।৯৮-৯৯ মৌসুমে সুযোগ হয় মাদ্রিদের "সি" দলের হয়ে খেলার । খেলে ফেলেন ২৮ ম্যাচ। একই মৌসুমে মাদ্রিদের "বি" দলের হয়ে খেলার সুযোগ হয় আরো চার ম্যাচ।মাঝে অবশ্য ১৯৯৭ সালের ২৭ নভেম্বর , রোজারবার্গের বিরুদ্ধে চ্যাম্পিয়নস লীগের ম্যাচে মাদ্রিদের সিনিয়র দলে ডাক পান। কিন্তু পুরো ম্যাচেই তার ঠিকানা হয় সাইডবেঞ্চে।১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে সিনিয়র দলে আবার ডাক পান। সে মৌসুমে বেশীর ভাগ ম্যাচে তাকে খেলতে হতো সাব হিসাবে। মাদ্রিদের হয়ে প্রথম ম্যাচ ও খেলেন তৎকালীন গোলকিপার বোডো ইগনার পরিবর্তিত হিসাবে।
ছবিঃ উইকিমিডিয়া |
১৯৯৯-২০০০ মৌসুমে হয়ে যান মাদ্রিদের প্রথম পছন্দের গোলকিপার। সে মৌসুমে , ১৯ তম জন্মদিনের মাত্র ৪দিন আগে মাদ্রিদের হয়ে খেলেন চ্যাম্পিয়নস লীগের ফাইনাল। ভ্যালেন্সিয়ার বিরুদ্ধ ৩-০ এর জয়ে তিনি বনে যান চ্যাম্পিয়নসলীগ জয়ী সর্বকনিষ্ঠ গোলকিপার ।
খারাপ সময় ক্যারিয়ারে আসেনি এমন খেলোয়াড় নেই বললেই চলে। ক্যাসিয়াসের ও এসেছিল।২০০১-০২ মৌসুমে নিজের বাজে ফর্মের কারনে সিজার সানচেজের কাছে নিজের জায়গা হারান।প্রবাদ আছে,"Life always provides you a second chance".সেবার চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ফাইনাল- ২০০২ এর আগে সানচেজ ইন্জুরীতে পড়লে সুযোগ হয় ক্যাসিয়াসের। বায়ার্ন লেভারকুসেনের সাথে ফাইনালে শেষ মুহূর্তের অসাধারন কিছু সেভ শিরোপা এনে দেয় মাদ্রিদকে।
ক্যাসিয়াস তার ক্যারিয়ারে ২০০৭-০৮ মৌসুমকে অন্যভাবে মনে রাখবে । সেমৌসুমে দুর্দান্ত এক ক্যাসিয়াসকে দেখে সমর্থকেরা। ৩৬ ম্যাচে মাত্র ৩২গোল হজম করে ক্যাসিয়াস। মাদ্রিদ ঘরে তোলে তাদের ৩১তম লা-লীগা শিরোপা আর ক্যাসিয়াস নিজ জিতেছিলো সংবাদপত্র মার্কা প্রদত্ত জামোরা (Zamora) ট্রফি। ২০০৮ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি ক্যাসিয়াস মাদ্রিদের হয়ে আজীবনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। একইসাথে সেবছর ফিফার বর্ষসেরা তালিকায় চারে জায়গা হয় ক্যাসিয়াসের।
মাত্র ২৭ বছর বয়সে গোলকিপার হিসাবে রিয়ালের হয়ে প্যাকো বুয়োর ৪৫৪ ম্যাচের রেকর্ড ভেঙে দেন। গুজব আছে , ২০০৯ সালের গ্রীষ্মকালীন উইন্ডোতে ম্যানসিটি ক্যাসিয়াসের জন্য ১২৯ মিলিয়ন পাউন্ড বিড করেছে।
মাদ্রিদের হয়ে করেছেন অসাধারণ সব সেভ। ০৯-১০ মৌসুমে সেভিয়ার সাথের সেভটি দর্শক মনে রাখবে আরো বহু বছর। গোলবারের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে অবিশ্বাস্য গতিতে ছুটে গিয়ে দিয়াগো পেরত্তির সাথে খুব কাছাঁকাছি অবস্থায় এক বনাম একের যে মোকাবেলায় জয়ী হয়েছিলেন ইকার, দর্শক তা মনে রাখবে আরো অনেকদিন। ইংল্যান্ডের খ্যাতনামা গোলকিপার গর্ডন বান্কস তো বলেই দিলেন ,
" গোলমুখে ইকার ক্যাসিয়াসের প্রতিক্রিয়া (রিফ্লেক্স) অসাধারণ। এমন দ্রুত গতির রিফ্লেক্স তিনি কখনো দেখেন নি। যদি ইকার এভাবে খেলতে থাকেন তাহলে তিনি ইতিহাসের সেরা গোলকিপারের জায়গা দখল করে নেবেন।”
এরপরের গল্পটা কিছুটা হতাশার। হোসে মরিনহোর সাথে মনোমালিন্যে দল থেকে বাদ পড়লেন ২০১২ সালের ২২ ডিসেম্বর মালাগার বিরুদ্ধে। এসব নিয়ে মিডিয়ার সামনে সরাসরি কথা বলে সমর্থকদের বাহবা কুড়িয়েছেন। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ক্যাসিয়াস ভয়াবহ ইন্জুরীতে পড়েন। আর মরিনহো সেভিয়ার গোলকিপার "ডিয়াগো লোপেজ" কে সাইন করান। ফলশ্রুতিতে ইন্জুরী থেকে ফিরেও মরিনহোর দলে জয়গা হয়নি ক্যাসিয়াসের।
২০১৩-১৪ মৌসুমে মাদ্রিদের নতুন বস হয় কার্লো আনচেলত্তি। তারপরেও ভাগ্য খোলেনি ইকারের। ইন্জুরীর ২৩৮ দিন পরে গ্যালাতেসেরে এর বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লীগের ম্যাচে মাঠে নামে ইকার। কিন্তু মাত্র ১৪ মিনিটের মাথায় আবারো ইন্জুরীতে পড়েন। ইন্জুরী থেকে ফিরলে আনচেলিত্তি তাকে কোপা-দেল-রে ও চ্যাম্পিয়নস লীগের দায়িত্ব দেন। সেবার টানা ৯৬২ মিনিট গোল হজম না করার রেকর্ড করেন যদিও সেটাই মাদ্রিদের হয়ে তার শেষ মৌসুম ছিল।
বিদায়বেলায় ক্যাসিয়াস মাদ্রিদের হয়ে জিতেছিলেন ৫টি লালীগা,৩ টি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিসহ মোট ১৬ টি শিরোপা। ২০১৪-১৫ মৌসুমে শেষবারের মতো মাদ্রিদের জার্সি গায়ে তুলেছিলেন। নিজের পড়তি ফর্ম আর কেইলর নাভাসকে সুযোগ দিতে ইকারকে পাড়ি জমাতে হলো পর্তুগালের এফসি পোর্ততে।অশ্রুশিক্ত হয়ে জানিয়েছিলেন তিনি মাদ্রিদ ছাড়তে চান না। মাদ্রিদই তার ঘর।
ছবিঃ উইকিমিডিয়া |
পোর্ত এফসি (২০১৫-১৯)
পোর্তর হয়ে ২০১৭ সালে জেতেন প্রাইমেরা লীগ। ২০১৯ সালের ১ মে পোর্তর হয়ে প্রশিক্ষণ চলাকালীন তিনি বুকের যন্ত্রণা অনুভব করেন এবং নিকটতম হাসপাতালে ভর্তি হন।পরে জানা যায় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। পরবর্তীতে ডাক্তারের পরামর্শে খেলা ছেড়ে দেন।স্পেন (২০০০-২০১৪)
ইউরো-বিশ্বকাপ-ইউরো! এই ত্রিজয়ে সবথেকে গুরুত্বপূর্ন অবদান কার? অনেকগুলো নাম আসতে পারে! আপনি বলতে পারেন জাভি-ইনিয়েস্তা-বুস্কেটসদের নাম । এরা ছিল মধ্যমাঠের মধ্যমনি ।আসতে পারে সার্জিয়-পিকে-পুয়োলদের নাম কিংবা বাদ যাবে না ভিয়া-তোরেস আর জাবি অ্যালোন্সোদের নাম। কিন্তু এদের সবাইকে ছাপিয়ে মনে রাখতে হবে একজন ক্যাসিয়াসকে। যিনি অধিনায়ক থেকে হয়েছিলেন মহানায়ক ।নায়ক থেকে মহানায়ক হয়ে ওঠার গল্প জানতে যেতে হবে আরো পেছনে। ২০০০ সালের ৩ জুন,মাত্র ১৯ বছর বয়সে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে দেশের হয়ে অভিষেক হয় সুইডেনের বিপক্ষে। সে ম্যাচে পরিবর্তিত খেলোয়াড় হিসাবে নামেন।
২০০২ বিশ্বকাপের প্রাথমিক দলে ছিলেন। পরবর্তীতে স্পেনের প্রথম পছন্দের গোলকিপার সান্তিয়াগো ক্যানিজারেস ইন্জুরীতে পড়লে মাত্র ২১ বছর বয়সেই দলের প্রথম পছন্দ হয়ে বিশ্বকাপে যান। সেই টুর্নামেন্টে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচে দুই পেনাল্টি সেভ , তাকে করে তুলেছিল সেইন্ট ইকার আর কোয়ার্টার ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে করা অসাধারণ সেভটি তো ফিফা প্রকাশিত সর্বকালের সেরা দশটির একটি।
এরপরে আরো একটি বিশ্বকাপ পেরিয়ে যায়।তবুও স্পেনের হতাশাগাথা শেষ হয় না। ২০০৮ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়নশীপে ইকার ক্যাসিয়াসকে করা হয় অধিনায়ক। তার অধিনায়কত্বে শুরু হয় স্পেনের সোনালি যুগ। সেবার ইউরো চ্যাম্পিয়নশীপ কোয়ার্টার ফাইনালে ইতালির মুখোমুখি হয় স্পেন।১২০মিনিটে খেলায় ফলাফল না আসলে ট্রাইব্রেকারে ডি-রজ্জি আর নাতালের শট রুখে দিয়ে জয় এনে দেন ক্যাসিয়াস। পরে ফাইনালে জার্মানিকে ১-০ ব্যবধানে হারিয়ে শিরোপা ঘরে তোলে স্পেন।
ছবিঃ উইকিমিডিয়া |
২০১০ বিশ্বকাপের আনসাং হিরো হলেন ক্যাসিয়াস। বিশ্বকাপে ৫ ম্যাচে রেখেছেন ক্লিনশীট।প্যারাগুয়ের সাথে ম্যাচে আছে দুর্দান্ত এক পেনাল্টি সেভ। এসব আপনি চাইলেই ভুলে যেতে পারেন !কিন্তু ফাইনালে আরিয়ান রোবেনের ওয়ান এন্ড ওয়ান পজিশনে করা দুইটি সেভ যা এনে দিয়েছিলো স্পেনকে বিশ্বকাপ আপনি চাইলেও ভুলতে পারবেন না।
আর ২০১২ ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে ট্রাইব্রেকারে পর্তুগালের মতিনহো আর আলভেসের শট ঠেকিয়ে দলকে নিয়ে গেলেন ফাইনালে। আর ফাইনালে ইতালিকে ৪-০ ব্যবধানে হারিয়ে আবারো ইউরো চ্যাম্পিয়ন স্পেন।
এতোকিছুর পরও তার শেষটা হলো বিবর্ন। ইতিহাস মাঝেমাঝে মহানায়কদের সাথে প্রতারণা করে।২০১৪ বিশ্বকাপ তারই একটা উদাহারণ। সেবার স্পেন ফিরলো প্রথম রাউন্ডেই। ২০১০ এর ফাইনালিস্ট নেদারল্যান্ডের কাছে ৫-১ আর ভিদাল-সানচেজ-ব্রাভোদের নিয়ে গড়া নতুন চিলির কাছে ২-০ ব্যবধানে হেরে বিদায়। আর ইকারের শেষটা হলো বিবর্ণ। যে শেষটা মনে করিয়ে দেবে চাঁদের ও আছে যে কলঙ্ক।
এক নজরে ক্যাসিয়াসের যত অর্জন
0 Comments
Post a Comment