অনুসন্ধিৎসু মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু প্রাচীন মিশর। এখানে পৃথিবীর এক গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতার সুচনা হয়েছিল। প্রাচীন মিশরকেই বলা হয় বিষ্ময় জাগানো সব স্তম্ভ পিরামিডের আঁতুড়ঘর। এই অঞ্চলের অধিকাংশ ব্যাপারই রহস্যময়। মিশরের প্রায় প্রতিটি পিরামিডের পিছনেই রয়েছে কোনও না কোনও রহস্য-কাহিনি। তুতানখামেনের সমাধি বা আবু সিম্বাল মন্দিরের রহস্য যেমন আজও অসংখ্য লেখক-তথ্যচিত্রকার-শিল্পীকে আকর্ষণ করে, তেমনই 'গিজার পিরামিড' বিভিন্ন আগ্রহ জাগায় ভাবুক মনে, রাখে বৈচিত্রময় সব আবেদন।
সারা বিশ্বের কাছে মিশরের আরেকটি পরিচিতি তাদের পিরামিডগুলোর কারণে, যেগুলো বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম বলে মনে করা হয়। মিশরের প্রাচীন রাজাদের মৃত্যুর পর এসব পিরামিডের ভেতর সমাহিত করা হতো। এসব শরীর পিরামিডের ভেতর এমন ভাবে মমি করে রাখা হতো, তাতে বোঝা যেত এই সভ্যতা তখন অনেক উন্নতি করেছিল।
মেসোপটেমিয়ার অধিবাসীরা সর্বপ্রথম পিরামিড আকৃতির স্থাপনা তৈরি করেছিল। এদের জিগুরাত নামে ডাকা হত। প্রাচীনকালে এদের উজ্জল সোনালি/তামাটে রঙ করা হত। যেহেতু এদের রোদে শুকানো কাদামাটির ইট দিয়ে তৈরী করা হত, এদের খুব সামান্যই অবশিষ্ট আছে। স্থানীয় ধর্মের জন্য সুমেরইয়, ব্যাবিলনইয়ান,এলামাইট,আক্কাদীয় এবং আসিরীয়ানরা জিগুরাত বানাত। প্রতিটি জিগুরাত একটি মন্দির কমপ্লেক্সের অন্তর্গত ছিল যেখানে অন্যান্য স্থাপনাও থাকত। জিগুরাতের পূর্বসুরী উত্তোলিত মাচা যা চার হাজার খ্রিস্টপূর্বের উবাইদ আমল থেকে বিদ্যমান । সবচেয়ে প্রাচীন জিগুরাতগুলো নির্মাণ শুরু হয়েছিল প্রাথমিক সুমেরীয় সভ্যতার শেষ দিকে। আর সর্বশেষ মেসোপটেমিয়ান জিগুরাত ৬ষ্ঠ খ্রিস্টপূর্বের।
গিজার পিরামিডের রহস্য
পিরামিড পৃথিবীর প্রাচীন সপ্তম আশ্চর্যের একটি। প্রাচীন মিশর শাসন করতেন ফিরাউনরা (প্রাচীন মিশরীয় শাসক বা রাজাদের ফিরাউন (Pharaoh) বলা হতো)। তাদেরকে কবর বা সমাধী দেয়ার জন্যই পিরামিড নির্মান করা হতো। মিসরে ছোটবড় ৭৫টি পিরামিড আছে। সবচেয়ে বড় এবং আকর্ষনীয় হচ্ছে গিজা'র পিরামিড যা খুফু'র পিরামিড হিসেবেও পরিচিত।খুফুর পিরামিডে তিনটি প্রধান প্রকোষ্ঠ রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে বেশ কয়েকটি যাতায়াতের পথ। এর গ্র্যান্ড গ্যালারির দৈর্ঘ্য ৪৭ মিটার, উচ্চতায় ৮ মিটার। বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে পিরামিডটির উত্তর প্রান্তীয় এলাকায় একটি ছোট শূন্যস্থানের সন্ধান পেয়েছেন। এবার পাওয়া বড় শূন্যস্থানটি লম্বায় ৩০ মিটার। গ্রেট পিরামিডের ভিতরে একটি জলযান পাওয়া গিয়েছে, যা এখনও পর্যন্ত অটুট অবস্থায় প্রাপ্ত প্রাচীনতম জলযান। লেবানিজ সেডার কাঠে তৈরি এই নৌকা ৪৭ মিটার লম্বা।
মিশোরের সবচেয়ে বড়, পুরোনো এবং আকর্ষনীয় পিরামিড হচ্ছে গিজা'র পিরামিড যা খুফু'র পিরামিড হিসেবেও পরিচিত। ১৪০ মিটার (৪৬০ ফুট) উঁচু খুফুর পিরামিডটি মিসরের রাজধানী কায়রোর উপকণ্ঠে গিজায় অবস্থিত। ফারাও শাসক খুফুর শাসনামলে খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০৯ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২৪৮৩ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে এটি নির্মাণ করা হয়। এই পিরামিড নিয়ে দুই বছর ধরে গবেষণা করছিল জাপান ও ফ্রান্সের একটি গবেষক দল। এর উচ্চতা প্রায় ৪৮১ ফুট। এটি ৭৫৫ বর্গফুট জমির উপর স্থাপিত। এটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় ২০ বছর এবং শ্রমিক খেটেছিল আনুমানিক ১ লাখ। পিরামিডটি তৈরি করা হয়েছিল বিশাল বিশাল পাথর খন্ড দিয়ে। পাথর খন্ডের এক একটির ওজন ছিল প্রায় ৬০ টন, আর দৈর্ঘ্য ছিল ৩০ থেকে ৪০ ফুটের মত। এগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল দূর দুরান্তের পাহাড় থেকে। পাথরের সাথে পাথর জোড়া দিয়ে পিরামিড তৈরি করা হত। চার হাজারের বছরের পুরানো এক সমাধিতে অঙ্কিত এক চিত্রে দেখা যায় এক বিশাল স্তম্ভকে স্লেজে করে সরানো হচ্ছে; অনেক মানুষ রশি দিয়ে সেই স্লেজ টেনে নিচ্ছে। আর তাদের মধ্যে একজন পাত্র থেকে জল ঢালছে বালির উপরে। এতে ঘর্ষণ প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। এভাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আড়াই টন ওজনের এক একটা ব্লক।
প্রাচীন মিশর এক রহস্যের আধার আর সেই রহস্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে গিজার পিরামিড। যার পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য আর রহস্য ।
0 Comments
Post a Comment