পৃথিবী নিঃসন্দেহে মানুষের কল্পনার থেকেও বেশি সুন্দর। আর সেই সৌন্দর্যের আধার হলো প্রকৃতি। প্রকৃতির এই নিদর্শনগুলো আমাদের মাঝে মুগ্ধতা ছড়ায়, জাগায় বিস্ময়। প্রচীনকাল থেকেই মানুষের মনে আকা ছিল রুপকথার রাজ্যের বিভিন্ন দৃশ্যকল্প। তেমনই এক কল্পরাজ্য রয়েছে ভেনেজুয়েলার দক্ষিন-পূর্বাঞ্চলে। যার নাম ক্যানাইমা ন্যাশনাল পার্ক। আর তারই বুক চিরে অবাধ ধারায় নেমে চলেছে অ্যাঞ্জেল ফলস। পার্ক আর জলপ্রপাতের এই সৌন্দর্য আর স্বকীয়তা রুপকথার কল্পিত রাজ্যগুলোকেও হার মানায়। ক্যানাইমার ইতিহাস দুই একশো বছরের নয়। শত কোটি বছরের। তখন জায়গাটি ছিল বেলে পাথরে পূর্ণ। সমতল পাহারগুলো বিভিন্ন কারনে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে একপর্যায়ে সুউচ্চ খাড়া পিলারে রুপ নেয়। ক্যানাইমার সবচেয়ে বড় বিষ্ময় হচ্ছে ১ কি.মি. উচ্চতার এই অ্যাঞ্জেল ফলস।
স্প্যানিশ ভাষায় একে বলা হয় ‘সালতো অ্যাঞ্জেল’ এবং পিমন ভাষায় ডাকা হয় ‘কেরেপাকুপাই’ নামে। যার অর্থ ‘গভীরতম স্থানের জলপ্রপাত।  স্থানীয় আদিবাসীরাও জলপ্রপাতটিকে বলে কেরেপাকুপাই মেরু। তাই হুগো শাভেজ জলপ্রপাতটির নাম পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এঞ্জেল জলপ্রপাত, বলিভার প্রদেশের গ্র্যান সাবানা অঞ্চলে, কানাইমা জাতীয় উদ্যানে অবস্থিত বেশ কিছু মূল আকর্ষণের সমন্বয়ে গঠিত। ভেনিজুয়েলা থেকে কানাইমা ক্যাম্প পর্যন্ত, যা সাধারণভাবে জলপ্রপাতের ভিতে নৌকা বিহারের প্রারম্ভিক কেন্দ্র। এটি  ‘কানাইমা ন্যাশনাল পার্ক’ এ অবস্থিত ‘আয়ুয়ান তেপুই’ পর্বত থেকে সৃষ্ট। যার উচ্চতা ৩ হাজার ২১২ ফিট বা ৯৭৯ মিটার। এই এঞ্জেল ফলস উচ্চতায় প্রায় ৩২১ তলা বিল্ডিংয়ের সমান।


অ্যাঞ্জেল ফলস আবিষ্কারের গল্প 

অ্যাঞ্জেল ফলসের আবিষ্কারের ইতিহাসটা বেশ মজার। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে জিমি অ্যাঞ্জেল নামে একজন মার্কিন বিমানচালক ভেনেজুয়েলায় গিয়েছেন সোনার খনি খুঁজতে। রুটিন মাফিক প্লেনে করে ভেনেজুয়েলার আওইয়ানতেপুই এলাকাতে ঘুরছিলেন। তিনি হঠাৎ দেখতে পান বিশাল এক জলপ্রপাত। জিমি অ্যাঞ্জেল তার বিমানটি জলপ্রপাতের উপরের পাহাড়ে ল্যান্ড করাতে চেয়েছিলেন। ঠিক তখনি বাধে বিপত্তি। কর্দমাক্ত জায়গা হওয়ায় বিমানের চাকা বিশেষ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ফলে তারা আর সেখান থেকে বিমানটি উড়াতে সক্ষম হননি। অ্যাঞ্জেল এবং তার স্ত্রী ম্যারি সহ তিনজন সঙ্গী তখন পায়ে হেটে রওনা দিতে বাধ্য হন। দুর্গম জঙ্গল পার হয়ে লোকালয়ে পৌছাতে তাদের সময় লাগে প্রায় ১১ দিন। জিমি অ্যাঞ্জেলের দু:সাহসিক অভিযানের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর তার নাম অনুসারে জলপ্রপাতটির নাম হয় অ্যাঞ্জেল জলপ্রপাত।


ভেনিজুয়েলায় ট্যুরিস্ট আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এই অ্যাঞ্জেল জলপ্রপাত। তবে এটি দুর্গম জায়গায় অবস্থিত বলে এখানে যাওয়া অনেকের জন্য কষ্টসাধ্য ব্যাপার। পুয়ের্তো ওয়ার্দাজ অথবা সিউদাদ বলিভার বিমানবন্দর থেকে প্রথমে পৌছাতে হবে কানাইমা ক্যাম্পে। সেখানে থেক নদীপথে যেতে হবে জলপ্রপাতটির কাছে। জুন থেকে ডিসেম্বর মাসে নদীতে নৌকা চলার মতো পানি থাকে। এটিই এই জলপ্রপাত দেখার সবচেয়ে ভাল সময়। ডিসেম্বর থেকে জুন মাস নদীতে পানি থাকে না। হলিউডের বেশ কিছু চলচিত্রের চিত্রায়ন হয়েছে এই জলপ্রপাতটিতে। ডিজনির এ্যানিমেটেড চালচিত্র ‘আপ’ সহ ‘ডায়নোসর’ এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পয়েন্ট ব্রেক’ নামের একটা চলচিত্রের দৃশ্যায়ন হয়েছে জলপ্রপাতটিতে।
এই জলপ্রপাতের পতনের শব্দের কাছে পৃথিবীর সবচাইতে জোরালো গর্জণটিও যেনো তুচ্ছ মনে হবে আপনার কাছে। বিশাল সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দও এটির কাছে হার মেনে যায়। এই জলপ্রপাতের চুড়া মেঘের চেয়েও উপরে। দেখে মনে হয় যেনো এই জলধারা স্বর্গ থেকে নেমে আসছে। আশ্চর্য সুন্দর এই জলধারাকে ঘিরে তৈরি হয় রঙধনু। এ যেন অপ্সরীর রূপের অমৃতধারা। আসলেই এর নামের সার্থকতা এর সৌন্দর্যে। এর রূপ, সৌন্দর্য, বিশালতা এমনই যা যে কাউকেই মন্ত্রমুগ্ধ করে দুর্নিবার আকর্ষণে। অবাক করা ব্যাপার হলো, জলপ্রপাতটি এতই উঁচুতে যে শুষ্ক মৌসুমে সেখান থেকে পানি মাটিতে পড়ার আগেই বাষ্পীভূত হয়ে যায়। বর্তমানে এটি ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের সংরক্ষিত একটি স্থান।