চলচ্চিত্রকথা
খোরশেদ আলম নামের এক তরুণ সদ্য গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে। কিন্তু বেকারত্ব তাকে গ্রাস করে খাচ্ছে। অনেকের মুখে শুনেছে, ঢাকা আসলে চাকুরী মিলবে। সেই আশা নিয়েই রতনপুর থেকে ঢাকা এসেছে মামার বাসায়। এরপর থেকে চাকুরীর আবেদন করছে, কিন্তু চাকুরীর কোনা নামগন্ধ নাই।এরপর বাধ্য হয়েই রতনপুর থানার ভেতরে সমাজের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদেরকে জিম্মি করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে থানার ডিসি, এ.এস.পি, কলেজের প্রিন্সিপাল, নাট্যকলার সাধারণ সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের বন্দুক-বোমার ভয় দেখিয়ে একটা রুমে আটকে রাখে। একইসাথে তিনি বারবার বলে ওঠেন তিনি কোনা একটা মহৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এসেছেন।
এখন পাঠকদের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, এ আবার কেমন মহৎ উদ্দেশ্য যার জন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জিম্মি করতে হবে? সেজন্যই এই মুহূর্তে জানতে হবে মহৎ উদ্দেশ্যগুলো আসলে ছিলো কি কি।
খোরশেদ আলমের মহৎ উদ্দেশ্য
১ . যে কোন প্রকার জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে দাড়াইবার পূর্বে প্রার্থীকে তাহার সকল সম্পত্তি রাষ্ট্রকে দান করিতে হইবে। নির্বাচনে হারুক কিংবা জিতুক তিনি আর কোনোদিনই ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিক হইতে পারবে না। এমনকি তার সন্তান-সন্ততীরাও কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিক হইতে পারিবে না, রাষ্ট্রই তার সকল ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করিবে।২ . প্রতি শুক্রবার সকল সরকারপ্রধান এবং বিরোধীদলীয় নেতা একসঙ্গে বসিয়া প্রাতরাশ করিবেন।
৩ . পুলিশ উৎকোচ গ্রহণ করিলে প্রমাণ সাপেক্ষে তার মৃত্যুদণ্ড এবং রাজনীতিবিদ ঘুষ খাইলে প্রমাণ সাপেক্ষে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা এবং গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে জাতির নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করিতে হইবে।
৪ . ইংলিশ মিডিয়াম, বাংলা মিডিয়াম, মাদ্রাসা, কারিগরি - দেশে চার রকমের শিক্ষাব্যবস্থা চলিবে না। সবার জন্য একই শিক্ষানীতি গ্রহণ করিতে হইবে।
৫ . সকল সরকারের আমলে সংগঠিত বোমা হামলার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের শাস্তি এবং প্রকৃত হামলাকারীদের শনাক্ত করিয়া তাদেরকে মুলৎপাটন করিতে হইবে। দেশে কোন প্রকার সন্ত্রাস বরদাস্ত করা হইবে না।
৬ . কৃষিপ্রধান এই দেশে কৃষকের ফসলের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করিতে হইবে। ঋণ খেলাপীদের ঋণ না দিয়ে কৃষকদের অধিক পরিমাণ এবং সহজ শর্তে ঋণ গ্রহণের সুযোগ করিয়া দিতে হইবে। এবং সকল নাগরিকের জন্য ৬ মাস হাতে-কলমে চাষাবাদ ট্রেনিং নেওয়া বাধ্যতামূলক করিতে হইবে।
৭ . সরকার অফিসে কাজকর্মের গতি ১০০ মিটার দৌড়ের মতো হইতে হইবে। পাবলিকের সঙ্গে সরকারী কর্মচারীদের আচারব্যবহার বন্ধুত্বপূর্ণ হইতে হইবে। দেশের অর্থনীতি এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এর সংস্থার খবরদারি বন্ধ করতে হবে।
৮ . প্রতি শুক্রবার সকাল ১১ টার মধ্যে দেশের প্রতিটা নাগরিক ১ টাকা করিয়া রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা দিবে। এই টাকা দিয়ে বেকারত্ব দূরীকরণ ফান্ড তৈরী করা হইবে। প্রতি সপ্তাহে এই রকম ১৪ কোটি টাকা (সে সময়ের জনসংখ্যা) আসিবে এবং উহা দ্বারা কলকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হইবে।
এই আটটি দাবি বাস্তবায়িত করার দাবি তোলেন খোরশেদ আলম! দাবি বাস্তবায়নের জন্য থানার ডিসিকে ফোন করতে হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে। ততক্ষণে চারিদিকে জানাজানিও হয়ে যাই জিম্মি হওয়ার সংবাদ। পরিবারের লোকজনও ভেঙে পড়তে শুরু হয়েছে। এভাবেই এগোতে থাকে গল্পের কাহিনী।
চলচ্চিত্র যেখানে বাস্তবতায় মিলেছে
মেড ইন বাংলাদেশ চলচ্চিত্রটি মূলত আনিসুল হক রচিত জিম্মি উপন্যাস এর চিত্ররূপ। এতে এক বেকার যুবকের সমাজ, রাষ্ট্র এবং প্রশাসনের দুর্নীতি এবং বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে অবদমিত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।১ . সিনেমার প্রথামাংশের খোরশেদ আলম এদেশের প্রতিটা গ্রাজুয়েশন শেষ করা ছেলের প্রতিচ্ছবি। যারা কিনা না পাচ্ছে চাকুরী আর না পারতেছে কৃষি কাজ করে জীবন ধারণ করতে।
২ . এ দেশের প্রতিটা নির্বাচন প্রার্থী ভোটের আগে আশার বাণী ঠিকই ছাড়ায় কিন্তু বাস্তবায়নের কোন ইচ্ছা তাদের নেই।
৩ . পত্রিকা খুললেই চোখের সামনে ভেসে উঠবে ধর্ষণ-চাঁদাবাজির সংবাদ। অথচ চোখের সামনেই ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা।
৪ . কৃষিপ্রধান এই দেশে ঋণের সাথে কৃষকের মিলছে না প্রাপ্ত সম্মান।
৫ . সরকারী অফিসেও মেলেনা সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় সেবা। ঘুষ-সুদের ব্যপারতো রয়েছে।
খোরশেদ আলমের প্রতিটা দাবীই যেনো এই সমাজের প্রতিচ্ছবি। খোরশেদদের দাবী কখনোই মেনে নেওয়া হয় না! সিনেমার শেষান্তে খোরশেদকে থানার ভেতরে বিভিন্ন উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের জিম্মি করার অপরাধে পুলিশ ধরে নিয়ে যাই। থোরশেদের " মেড ইন বাংলাদেশ " একটা স্বপ্নই রয়ে যাই!
( পুনশ্চ : চলচ্চিত্রে খোরশেদ আলম চরিত্রে অভিনয় করেছেন জাহিদ হাসান। )
0 Comments
Post a Comment