১ . হুমায়ূনের উদরপূর্তি!
১৯৭৭ সালের কথা। লেখক হুমায়ূন আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রের নর্থডাকোটা স্টেট ইউনিভারসিটিতে কেমিস্ট্রির মতো রসহীন একটা বিষয়ে পড়াশোনা করতে গেছেন। উঠেছেন হোটেল গ্রেভার ইনে। সেখান থেকে রাতের বেলাতে খেতে গেছেন বিফ এন্ড বান রেস্তোরাতে। বিফ এন্ড বান রেস্তোরা দেখতে আলো-ঝলমলে ছোটখাটো ধরনের। ভেতরে প্রবেশ করে দেখলেন তিনটা ফুটফুটে তরুণী খাবার দিচ্ছে, অর্ডার নিচ্ছে।
একটা টেবিলের সামনে বসতেই নিজের পকেটে হাত রাখলেন। সেখানে রয়েছে ১৫ ডলার। সেসময়ে বাইরের দেশ থেকে কেউ যুক্তরাষ্ট্রে এলে ২০ ডলারের বেশী সঙ্গে নিতে পারতো না। লেখক নিজেও তাই এনেছিলেন কিন্তু পথে লোভে পড়ে এক বক্স মালব্রো সিগারেট কিনে ফেলেছেন।
মেনুকার্ড দেখে সবথেকে কমদামী খাবার ফ্রেন্স টোস্ট অর্ডার দিলেন। শুধুমাত্র ফ্রেন্স টোস্ট শুনে অর্ডার গ্রহীতা অবাক হলেন। এরপরে আরো তিন-চার রজনী কেটে গেছে। নিয়মিত একই খাবার খাচ্ছেন। অবশ্য ততদিনে ডলারের অভাব তার মিটে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় তাকে অগ্রিম ৪০০ ডলার দিয়েছে। ছোটভাই জাফর ইকবাল ১০০ ডলারের একটা চেক পাঠিয়েছেন। সেটাও ভাঙিয়েছেন। কিন্তু তবু তিনি নিয়মিত ফ্রেন্স টোস্টই খাচ্ছেন। খেতে গেলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সাদা ধবধবে এক প্লেট ভাত, একটা বাটিতে শর্ষে বাটা দিয়ে ইলিশ মাছ, কাঁচা লঙ্কা আর কাগজী লেবু।এসব মনে পড়লে কিছুই খেতে ইচ্ছা করে না। তাই চোখ বন্ধ করে খেয়ে যাচ্ছেন ফ্রেন্স টোস্ট।
ষষ্ঠ রজনীতে খাবার খেতে গিয়ে দেখেন কেউ তার অর্ডার নিতে আসছে না। তিনি ভাবতে বসেছেন, বোধহয় নিয়মিত ফ্রেন্স টোস্ট অর্ডারেই তার এই দশা। কিছুক্ষণ পরে এক সুন্দরী তরুণী এসে যা বললো, তাতে লেখক হকচকিয়ে গেলেন। কথাগুলো এরকম, " দেখো আহমদ, আমরা জানি তোমার সময়টা ভালো যাচ্ছে না, দিনের পর দিন একটা কুৎসিত খাবার তুমি মুখ বুঝে খেয়ো যাচ্ছো, টাকা পয়সার কস্টের মতো কস্ট তো আর কিছুই হতে পারে না, তবু বলছি নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো, দুঃসময় অবশ্যই একদিন কাটবে। " এরপরে আরো বললেন," আজকে তোমার জন্য আমরা একটা খাবারের ব্যবস্থা করেছি। এর কোন মুল্য তোমাকে দিতে হবেনা। "
কিছুক্ষণ পরে একটা ট্রেতে টি-বুন স্টেকের সাথে কফি, আইসক্রিমের মতো অনেক টুকিটাকি খাবার সাজিয়ে এনে রাখলেন লেখকের সামনে। লেখক একবার বলতে চেয়েছিলেন, ব্যাপারটা তোমরা যা ভাবছো তা নয়। পরমুহূর্তে ভাবলেন, কি দরকার! পরদেশের তরুণীরা একটা অপরিচিত তরুণের জন্য মায়া দেখাচ্ছে, এটাই বা কম কিসের।
লেখক খাচ্ছেন, পরম মমতা নিয়ে খাচ্ছেন!
২ . ডানবর হলের জীবন
নর্থডাকোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে ক্লাস হয় তার নাম ডানবর হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩ নং কক্ষে কোয়ান্টাম মেকানিকসের ক্লাস শুরু হলো। কোর্স নং ৫২৯। নর্থডাকোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০ লেভেলের কোর্সগুলো আন্ডারগ্রাজুয়েটদের, ৩০০ লেভেলের কোর্সগুলো আন্ডারগ্রাজুয়েটদের উপরের আর ৪০০-৫০০ লেভেলের কোর্সগুলো গ্রাজুয়েটদের জন্য।
লেখক নিয়ে বসলেন ৫২৯ নং কোর্সটি। অথচ তেমন কোন ধারনাই ছিলো না তার এ সম্পর্কে। লেখক শুধুমাত্র নিজের আত্মবিশ্বাসের উপর ভর করেই এ কোর্সটি নিয়ে ফেলেন। কিন্তু মিডটার্ম পরীক্ষাতে সাদা খাতা জমা দিয়েই তার কিছুটা বোধগম্য হয়। কিন্তু সে পরীক্ষাতে একটি অন্ধ ছেলে সবচেয়ে বেশী নম্বর পেলে আবারও কিছুটা উৎসাহ পান। কোর্স টিচার মার্ক গর্ডন তাকে ডেকে নেন নিজের রুমে। বোঝাতে শুরু করেন কেনো তিনি কোর্সটি ছেড়ে দিচ্ছেন নাহ! কিন্তু হুমায়ূন আহমদ ছিলেন নাছোড় বান্দা। রেখে দিলেন ৫২৯ নম্বর কোর্সটি। পড়া শুরু করলেন কোর্স সম্পর্কিত সকল ব্যাসিক বই। বুঝতে শুরু করলেন কোয়ান্টাম মেকানিকসের সব তত্ত্ব। আর বছর শেষ পরীক্ষাতে পেলেন ১০০ তে ১০০। এপরীক্ষার পরে হুমায়ূন আহমেদ পুরো ক্যাম্পাসে পরিচিত হয়ে উঠলেন। সাথেসাথে মার্ক গর্ডনের কাছ থেকে পেলেন একটা চিঠি! যাতে লেখা - থিওরেটিকাল কোয়ান্টাম মেকানিকসের ওপর আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করবে!
৩ . বাংলাদেশ নাইট
মোরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক বর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে অন্যান্য দেশের সঙ্গে উদ্যাপিত হবে বাংলাদেশ নাইট। এই অঞ্চলে বাংলাদেশের একমাত্র ছাত্র হচ্ছে মিজান, আর লেখক হচ্ছেন নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। মিজানের একমাত্র পরামর্শদাতা তিনিই, আশপাশে সাত শ মাইলের মধ্যে দ্বিতীয় বাঙালি নেই।কফির পেয়ালা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখকের কাছে মিজানের টেলিফোন। সে টেলিফোনে নানাবিধ আলোচনা ঠিকই হলো কিন্তু আসলে সবই ফাকা। তবে মুখের কথায় মেনু কার্ডে থাকবে খিচুড়ি আর মুখে থাকবে জাতীয় সঙ্গীতের বুলি।
উৎসবের দিন ভোরবেলায় প্রকাণ্ড সসপ্যানে খিচুড়ি বসিয়ে দেওয়া হলো। চাল, ডাল, আনাজপাতি সেদ্ধ হচ্ছে। দুটো মুরগি কুচি কুচি করে ছেড়ে দেওয়া হলো। এক পাউন্ডের মতো কিমা ছিল, তাও ঢেলে দেওয়া হলো। যত ধরনের গরম মসলা ছিল তাও বাদ গেলোনা। জ্বাল হতে থাকল।
মিজান বলে উঠলো, খিচুড়ির আসল রহস্য হলো মিক্সিংয়ে। আপনি ভয় করবেন না। জিনিস ভালোই দাঁড়াবে।
সে একটা খুন্তি দিয়ে প্রবল বেগে নাড়তেও শুরু করল। ঘণ্টা দুয়েক পর যা দাঁড়াল তা দেখে বুকে কাঁপন লাগতে শুরু করলো লেখকের। ঘন সিরাপের মতো একটা তরল পদার্থ। ওপরে আবার দুধের সরের মতো পড়েছে।
জিনিসটার রং দাঁড়িয়েছে ঘন কৃষ্ণ। মিজান শুকনো গলায় লেখককে বলে উঠলো, কালো হলো কেন বলুন তো, হুমায়ূন ভাই। কালো রঙের কিছুই তো দিইনি।
লেখক সেই প্রশ্নের জবাব দিতে পারলেন না। মিজান বলল, টমেটো পেস্ট দিয়ে দেব নাকি?লেখক দিতে বললেন। টমেটো পেস্ট দেওয়া হলো, লাল রঙের কিছু ফুড কালার দেওয়া হলো! কিন্তু কালো রঙ আরো কালো হয়ে উঠলো।
দুজনেরই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ার মতো অবস্থা। জাতীয় সংগীতেরও কোনো ব্যবস্থা হলো না। মিজানের গানের গলা লেখকের চেয়েও খারাপ। যখন গান ধরে মনে হয় গলায় সর্দি নিয়ে পাতিহাঁস ডাকছে। শিকাগো থেকে পানও এসে পৌঁছাল না।
অনুষ্ঠান সন্ধ্যায়। বিকেলে এক অদ্ভুত ব্যাপার হলো। লেখক অবাক হয়ে দেখলেন দূর দূর থেকে গাড়ি নিয়ে বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা আসতে শুরু করেছে। শুনা গেলো, মিজান নাকি আশপাশের যত ইউনিভার্সিটি আছে, সব ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশ নাইটের খবর দিয়ে চিঠি দিয়েছিল। দেড় হাজার মাইল দূরে মন্টানো স্টেট ইউনিভার্সিটি, সেখান থেকে একটি মেয়ে গ্রে হাউন্ড বাসে করে একা একা চলে এসেছে। মিনোসোটা থেকে এসেছে ১০ জনের একটা বিরাট দল। তারা সঙ্গে নানান রকম পিঠা নিয়ে এসেছে। গ্রান্ড ফোকস থেকে এসেছেন করিম সাহেব, তাঁর ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রী। এই অসম্ভব কর্মঠ মহিলাটি এসেই আমাদের খিচুড়ি ফেলে দিয়ে নতুন খিচুড়ি বসালেন। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে সাউথ ডাকোটার ফলস স্প্রিং থেকে একদল ছেলেমেয়ে এসে উপস্থিত হলো।
মিজান আনন্দে লাফাবে না চেঁচাবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। চুপচাপ বসে আছে, মাঝে মাঝে গম্ভীর গলায় বলছে, দেখ শালা বাংলাদেশ কী জিনিস। দেখে যা।
অনুষ্ঠান শুরু হলো দেশাত্মবোধক গান দিয়ে।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি...।
অন্যান্য স্টেট থেকে মেয়েরা যারা এসেছে, তারাই শুধু গাইছে। এত সুন্দর গাইছে। এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে গান শুনে দেশের জন্যে আমার বুক হু হু করতে লাগল। চোখে জল এসে গেল। কেউ যেন তা দেখতে না পায় সে জন্য মাথা নিচু করে বসে রইলাম।
পরদিন ফার্গোফোরম পত্রিকায় বাংলাদেশ নাইট সম্পর্কে একটা খবর ছাপা হলো। খবরের অংশবিশেষ এ রকম—
একটি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ জাতির অনুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। অনুষ্ঠানটি শুরু হয় দেশের গান দিয়ে। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, গান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশি ছেলেমেয়েরা সব কাঁদতে শুরু করল। আমি আমার দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতা জীবনে এমন মধুর দৃশ্য দেখিনি...!
সোর্স : হুমায়ূন আহমেদের আত্মস্মৃতি বই " হোটেল গ্রেভার ইন "।
0 Comments
Post a Comment