কলোসিয়াম ইতালির রোম শহরে অবস্থিত একটি উপবৃত্তাকার ছাদবিহীন মঞ্চ। রোমান সাম্রাজ্যে নির্মিত এই গ্যালারি বা মঞ্চকে, সেসময়ের শাসকরা গ্লাডিয়েটরসদের মধ্যে লড়াইয়ের প্রতিযোগিতার প্রদর্শনী বা জনগণের উদ্দেশ্যে অন্য কোন প্রদর্শনীর কাজে ব্যবহার করত। এটিকে রোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় স্থাপনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি নির্মাণ করতে ব্যাবহার করা হয়েছিল পাথর এবং কংক্রিট। কলোসিয়াম ৬ একর ভূমির উপর নির্মাণ করা হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ১৮৯ মিটার এবং প্রস্থ ১৫৬ মিটার। কলোসিয়ামে ছিল ৮০টি প্রবেশদ্বার। সেখানে ৫০ হাজার দর্শক একসাথে বসে গ্লাডয়েটরসদের লড়াই উপভোগ করতে পারত। রোমান সাম্রাজ্যের সকল নাগরিকের এই জায়গায় বিনামূল্যে প্রবেশাধিকার ছিল।
অদ্ভূত কাঠামোর ইমারতটির প্রতিটি ইট-কাঠ-পাথরে মিশে আছে নিহতদের অন্তিম নিঃশ্বাস। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলা সেই বিভৎস, জঘন্যতম প্রাণ সংহারী দ্বৈত-যুদ্ধের ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে বিশেষ নির্মাণশৈলীর এ কলোসিয়াম। বিশ্ব সপ্তমাশ্চর্যের একটি এটি।
কিভাবে এই কলোসিয়ামের সূচনা হয়েছিল রোমে
সম্রাটদের নির্দেশে রাজকোষের অর্থে সেই সময় এক ‘বিশেষ খেলার জন্য উত্তর আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমদানি করা হতো হাজারে হাজারে হাতি, গন্ডার এবং সিংহ। ভল্লুকের সঙ্গে হাতি, হাতির সঙ্গে বুনো মহিষ বা গন্ডারের সঙ্গে হাতির লড়াই দেখত হাজারো বিশ্ব সম্ভ্রান্তরা। পশুদের মৃত্যুবেদনার হুংকারের সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়ত পুরো গ্যালারি। কলোসিয়ামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ৯ হাজারেরও বেশি পশুর প্রাণ গিয়েছিল। তবে দীর্ঘদিন পশুর লড়াই আর এগুলোর করুণ মৃত্যু দেখতে দেখতে একঘেয়েমি বোধ করেন সম্রাট টাইটাস। পশুর স্থলে মানুষে-মানুষে লড়াইয়ের ধারণা এলো তার মনে। আর পশুর খেলা বন্ধ করে, শুরু করা হলো মানুষের রক্তের হলি খেলা। শুরু হলো মানুষের মৃত্যুর করুণ ও বীভৎস কাহিনী।
প্রথমে যুদ্ধবন্দিদের মরণপণ লড়াই শুরু। যতক্ষণ না দুইজনের একজনের মৃত্যু হতো, ততক্ষণ পর্যন্ত চলত দ্বৈত-লড়াই। কিন্তু ‘মাত্র’ একশোটি খেলা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল টাইটাসের। এরপর হঠাৎ করেই একদিন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যান তিনি। বন্ধ হয়ে যায় এই খেলা। লম্বা বিরতির পর ৬৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রুটাস ভ্রাতৃদ্বয় ফের চালু করেন ‘ঐতিহ্যবাহী’ ওই খেলা। তারা ‘গ্ল্যাডিয়াস’ (খাটো তরবারির) লড়াই চালু করেন। লড়াইকারীদের বলা হতো গ্ল্যাডিয়েটর। লড়াই চলাকালে কোনো এক গ্ল্যাডিয়েটর আহত হয়ে পড়ে গেলে উল্লাসে ফেটে পড়ত পুরো কলোসিয়াম। মৃত্যু ভয়ে ভীত, ক্ষত-বিক্ষত গ্ল্যাডিয়েটর রেওয়াজ অনুযায়ী বা হাত তুলে সম্রাটের করুণা প্রার্থনা করত, প্রাণভিক্ষা চাইত। মঞ্জুর করা না করা সম্পূর্ণ সম্রাটের মন-মেজাজের ওপর নির্ভর করত। সম্রাটের বাম হাতের বুড়ো আঙুল আকাশ নির্দেশ করলে অপর গ্ল্যাডিয়েটর বুঝে নিত- তাকে ছেড়ে দাও। কিন্তু ভূমি নির্দেশ করার অর্থ, শেষ করে দাও। রোমের দুর্ধর্ষ শাসক জুলিয়াস সিজার এখানে বসেই ৩০০ গ্ল্যাডিয়েটরের লড়াই উপভোগ করেন। আর সম্রাট ট্রাজান উপভোগ করেন পাঁচ হাজার দ্বৈত-যুদ্ধ। খ্রিস্টানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান হতো এ কলোসিয়ামে। সেখানে ভ্যাটিকানের সর্বোচ্চ খ্রিস্টান ধর্মগুরুরা উপস্থিত থাকেন। অংশ নিতেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা।
সেখানে এক ধর্মীয় উৎসবে উপস্থিত প্রত্যেককে কলোসিয়ামের এক মুঠো করে মাটি উপহার দিতে চেয়েছিলেন পোপ গ্রেগরি। কিন্তু কেউই তা নিতে রাজি হননি। তাদের অভিযোগ, ‘এই মাটি হাতে নিয়ে চাপ দিলে এখনো বের হবে তাজা রক্ত, রয়েছে রক্তের গন্ধ। তাই এই পাপের ভাগি আমরা হতে চাই না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যত রক্ত ঝরেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি রক্ত ঝরেছে রোমের কলোসিয়ামের এক চিলতে মাটিতে।
ইউনেস্কো কলোসিয়ামকে ১৯৯০ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী অঞ্চলের স্বীকৃতি দেয়। এটি পৃথিবীতে মনুষ্যসৃষ্ট আধুনিক সপ্তাশ্চর্যের একটি বলে নির্বাচিত হয় ২০০৭ সালে। প্রতি বছর পাঁচ মিলিয়ন দর্শনার্থী আসেন এই কলোসিয়ামে। প্রতি মাসের প্রথম রবিবার কোন প্রবেশমূল্য নেওয়া হয় না। ট্রেভি ফাউনটেইনের মত কলোসিয়ামের চারপাশও মনোমুগ্ধকর।
0 Comments
Post a Comment