আমার চেয়ে সামর্থ্যবান অনেক ক্রিকেটারই আমার সময়ে ছিলেন। কিন্তু তারা কেন যে আমাকে ছাড়িয়ে যেতে পারলেন না, তা আমার বোধগম্য নয়।


সময় পেরিয়ে গেছে অনেক। এরই মাঝে ক্রিকেটের বাইশ গজের পিচে আগমন ঘটেছে বহু রথী-মহারথীদের। বলে-ব্যাটে এরাও করেছে বিশ্বশাসন। কিন্তু কেউ কি তাকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে? না পারেনি। উক্তিটা ডন  ব্র্যাডম্যানের। শুধু তার সময়ের কেন, তার পরবর্তী সময়েও কেউ তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। কিন্তু কেন তিনি অনন্য?


ব্র্যাডম্যান অভিষিক্ত হয়েছেন ১৯৩০ সালে। কিন্তু অভিষিক্ত টেস্ট নিজের পরম মহিমাতে রাঙাতে পারেননি।  তিক্ত অভিজ্ঞতায় সিক্ত হন তিনি। পোতানো উইকেটে কট আউটে বিদায় নেন। অস্ট্রেলিয়া দল দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র গুটিয়ে যায় মাত্র ৬৬ রানে। পরাজিত হয়  ৬৭৫ রানের সুবিশাল ব্যবধানে। এখন পর্যন্ত, এ ব্যবধানটি টেস্ট রেকর্ড হিসেবে টিকে আছে। মাত্র ১৮ ও ১ রান করার পর নির্বাচকেরা তাকে বাদ দেন।  পরের টেস্টে দ্বাদশ খেলোয়াড় হিসাবে পানি টানার সুযোগ হয় ইতিহাসের সেরা প্লেয়ারটির।


মেলবোর্নে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে আবারো দলে ফেরানো হয় তরুণ ব্র্যাডম্যানকে। খেলেন ৭৯ ও ১১২ রানের ইনিংস। সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে টেস্ট সেঞ্চুরি করার গৌরব অর্জন করেন। অবশ্য অ্যাডিলেডে অনুষ্ঠিত পরের টেস্টেই অস্ট্রেলিয়ার আর্চি জ্যাকসন অভিষেক টেস্টে ১৬৪ রান তুলে তার এ রেকর্ড ভঙ্গ করেন।


১৯৩০ সালে ইংল্যান্ড সফর! সে  লক্ষ্যেই শুরু হয় যাচাই-বাছাই। দুই দলে ভাগ করে শুরু হয় ম্যাচ। সে ম্যাচে প্রথম ইনিংসে প্যাভিলিয়নে ফেরেন শেষ ব্যক্তি হিসেবে। স্কোরবোর্ডে তার নামের পাশে ১২৪ রান। তবে দলকে ফলো অনের হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি। অধিনায়ক বিল উডফুল ব্র্যাডম্যানকে দ্বিতীয় ইনিংসে পাঠান উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান  হিসেবে। আর দিনের খেলা শেষ হলে ব্র্যাডম্যান থাকেন অপরাজিত ২০৫ রানে। পরের দিন ২২৫ করে আউট হলেও ইংল্যান্ড সিরিজের দল থেকে কেউ আউট করতে পারেনি।
সেবার লর্ডসে গিয়ে করলেন সেঞ্চুরি। তাও আবার প্রথম  সেশন শেষ হবার ঢের আগেই। মাত্র তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসাবে সে রেকর্ডের অংশীদার বনে গেলেন। সেই সফরে রান বন্যায় ভাসিয়েছেন প্রতিপক্ষ দলের বোলারদের। সফরে ৫টি টেস্টসহ আরও বেশ কিছু প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে  অস্ট্রেলিয়া দল। আর তাতেই ৬টি ডাবল সেঞ্চুরি, ১০টি সেঞ্চুরি এবং ১৫টি হাফ সেঞ্চুরি করেন ব্র্যাডম্যান।সফর শেষে রান সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৩,০০০। আর গড় ৯৮.৬৬!



১৯৩২ সালের কথা। অস্ট্রেলিয়া দলের  দক্ষিণ আফ্রিকা সফর। সেই সফরের পরে টিম অস্ট্রেলিয়ার গন্তব্য আমেরিকা। মে থেকে আগস্টের চার মাসে প্রীতি আর প্রদর্শনী মিলে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ সংখ্যা দাড়ায় ৫১। ব্র্যাডম্যান খেলেন  ৫০ টি। রান করেন ৩,৭৬৫। তার মধ্যে একটি ম্যাচে করেন শূন্য, মানে ডাক। ব্যাটসম্যান হিসেবে তখন খ্যাতির তুঙ্গে ডন।   পত্রপত্রিকায় প্রতিনিয়ত লেখালেখি হয় তাকে নিয়েই, ছাপা হয় নানা ধাচের ছবি।
 ওয়াল্ট ডিজনিরও চোখে পড়ে সে লেখাগুলি। ডন ব্র্যাডম্যানের নামের আইডিয়া থেকেই সেসময়ে তিনি সৃষ্টি করেন তার অমর কার্টুন চরিত্র ডোনাল্ড ডাক।


ব্রায়ান লারার ৪০০ রানের ইনিংসটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পেয়েছে অমরত্ব। এ রেকর্ড ভাঙার নয়। কিন্তু ব্রায়ান লারার কথা কেন এখানে?
কেননা প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে ডন ব্র্যাডম্যান একবার ৪০০ পেরোনো ইনিংস খেলেছিলেন, করেছিলেন ৪৫২।  ক্রিজে ছিলেন মাত্র ৪১৫ মিনিট।


বডিলাইন সিরিজে ব্র্যাডম্যানের ব্যাটিংয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে ও খেলোয়াড়ী জীবনের বাকীটা সময় বহমান থাকে।
উক্তিটি অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যান জ্যাক ফিঙ্গলটনের। ১৯৩২-৩৩ মৌসুম! ইংল্যান্ডের অস্ট্রেলিয়া সফর।অস্ট্রেলিয়া সফরের দলে হ্যারল্ড লারউড ও বিল ভস-সহ পাঁচজন ফাস্ট বোলারের নাম ঘোষণা করে ইংল্যান্ড। এক সিরিজে এতোগুলো ফাস্ট বোলারের নাম ঘোষণা ব্র্যাডম্যানকে ইংল্যান্ডের নতুন ফন্দীর ব্যাপারে ধারণা ঠিকই  দিয়েছিলো কিন্তু প্রতিরোধের উপায় খুঁজতে বেগ পেতে হচ্ছিলো তাকে। প্রথম টেস্ট খেলেননি, দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে প্রথম বলেই আউট যা তার ক্যারিয়ারের প্রথম। দ্বিতীয় ইনিংসে নিজেকে ফিরে পান ডন। খেলেন ১০৩ রানের ইনিংস। অস্ট্রেলিয়া শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা জিতেও নেয়।


ইংল্যান্ডের নতুন বোলিং কৌশলে বলগুলো প্রায়শই শরীর বরাবর ধেয়ে আসছিল। অস্ট্রেলিয়ার সংবাদপত্রগুলো এ ধরনের বোলিং কৌশল অবলম্বনকে বডিলাইন নামে বর্ণনা করে। সেসময়ে এ ধরনের বোলিং  বিপজ্জনক ও খেলোয়াড়সূলভ বলে বিবেচ্য ছিলনা। ১৯৩০-এর দশকে ব্যাটসম্যানেরা মাথায় কোন ধরনের সুরক্ষা আবরণ বা হেলমেট ব্যবহার করতেন না।
শেষের তিন টেস্টেই জয়ী দলের নাম ইংল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়া দল তখনো সে কৌশল রপ্ত করে তার বিপরীতে মানিয়ে নিতে পারেনি।
ব্র্যাডম্যান তার ব্যাটিংয়ের ধরন পরিবর্তন করেন। রান সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। কখনো সফল হয়েছেন,  কখনো বা ব্যর্থ। ইংল্যান্ড দলের  বুদ্ধিদীপ্ত খেলায় লেগ সাইডে বেশীরভাগ ফিল্ডার রাখতে শুরু করে।সেসময়ে ব্র্যাডম্যান কিছুটা পিছিয়ে বলকে অফ সাইডে ফেলে রান সংগ্রহের পরিকল্পনা করেন।তেমন ভালো খেলতে না পারলেও সে সিরিজে তিনি ৫৬.৫৭ গড়ে রান তুলেছিলেন যা এসময়ের যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্য লোভনীয় গড়। তবে নামটা ডন ব্র্যাডম্যান বলেই যথেষ্ট ভালো নয়।


দ্বিপাক্ষিক কোনো সিরিজে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান কত জানেন?  ৯৭৪। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৭ ইনিংসে ডন করেছিলেন ৯৭৪ রান।
ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ৩৩৪ রান ছাড়াও সে সিরিজে আরো ২টি ডাবল সেঞ্চুরি ও ১টি সেঞ্চুরি। সাত ইনিংসের রান ছিলো যথাক্রমে, ৮, ১৩১,২৫৪, ১,৩৩৪,১৪,২৩২।


নিজের শেষ টেস্টের শেষ ইনিংসে ব্যাট করতে নামলেন স্যার ডন ব্রাডম্যান। মাত্র চার রান করতে পারলেই গড় থাকবে ১০০।
ক্রিকেট গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। সারাজীবন বোলারদের রানবন্যায় ভাসানো ডন করতে পারলেন না চার রান। ফিরে গেলেন শূন্য রানেই। গড় হয়ে থাকলো ৯৯.৯৪। টেস্ট ম্যাচের মাত্র আশি ইনিংসে ব্যাট করে ৬৯৯৬ রান করেও একটুখানি অপূর্ণতা
নিজের শেষ টেস্টের শেষ ইনিংসে ব্যাট করতে নামলেন স্যার ডন ব্রাডম্যান। মাত্র চার রান করতে পারলেই গড় থাকবে ১০০ । 

ক্রিকেট গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। সারাজীবন বোলারদের রানবন্যায় ভাসানো ডন করতে পারলেন না চার রান । ফিরে গেলেন শূন্য রানেই । গড় হয়ে থাকলো ৯৯.৯৪ । টেস্ট ম্যাচের মাত্র আশি ইনিংসে ব্যাট করে ৬৯৯৬ রান করেও একটুখানি অপূর্ণতা নিয়েই শেষ হলো ব্র্যাডম্যানের ক্যারিয়ার। 



বিশ্বযুদ্ধ তিনি করেননি। বরং যুদ্ধের কারণে হারিয়ে গেছে তার ক্যারিয়ারের বেশ কিছু মূল্যবান বছর। তবে তিনি যুদ্ধে না থেকেও ছিলেন। ব্র্যাডম্যানের ব্যাটিং টুমরো ব্যবহার করা হয়েছিলো ঠিকই। মানে, ব্র্যাডম্যানের ব্যাটিং বার্তা হিসাবে ব্যবহার করেই আক্রমণ করবে মিত্রবাহিনী!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তার ক্যারিয়ার বেশী লম্বা হয় নি । তাতেও মাত্র ৫২ টেস্টে ২৯ বার সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিলেন ব্র্যাডম্যান । ঘরোয়া ক্রিকেটেও রানের ফুলঝুরি ছড়িয়েছেন। করেছেন আটাশ হাজারেরও বেশী রান । সেখানেও গড় ৯৫ এর বেশী । মনে রাখার জন্য নামের পাশে তার সংখ্যাই তার হয়ে কথা বলবে । তিনি থাকবেন অনন্য আর অভাবনীয় হয়ে । 

আচ্ছা , ক্রিকেটার না হলে কি হতেন তিনি ? মনে হয় সুরকার ! 'এভরিডে ইজ আ রেইনবো ডে ফর মি’ তারই সুরে গাওয়া গান।