পৃথিবীতে সৌন্দর্য্যের আধার হলো প্রকৃতি। প্রকৃতির বিভিন্ন নিদর্শনগুলো আমাদের মাঝে মুগ্ধতা ছড়ায়, জাগায় বিস্ময়। পাহাড়, সমুদ্র, ঝর্ণা, মরুভূমি ইত্যাদি জায়গা গুলো নিয়ে মানুষের শত জল্পনা-কল্পনা।  প্রকৃতিকে ঘিরেই লেখা কবির কবিতা, আঁকা হয় শিল্পীর ছবি। এই সকল সৌন্দর্য্যের মধ্যে বেশ খানিকটা জায়গা দখল করে আছে বিভিন্ন জলপ্রপাত। পৃথিবীর গভীরতম যতগুলো জলপ্রপাত আছে তার মধ্যে অন্যতম ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত। যেখানে পাহাড়ি নদী আছড়ে পড়ছে প্রবল বেগে। সৃষ্টি করেছে চমৎকার রংধনু। বিশ্বের সেরা আকর্ষণীয় জায়গা এটি। ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের নাম শুনেছেন অনেকেই। দেখার সৌভাগ্যও হয়েছে হয়তো কারো কারো -

আফ্রিকা মহাদেশের দুটি দেশ জাম্বিয়া ও জিম্বাবুয়ের সীমানায় অবস্থিত পৃথিবীর দীর্ঘতম জলপ্রপাত। দুটি দেশের সীমান্তবর্তী নদী জাম্বেজি থেকেই এর উৎপত্তি। ১৯ শতকের মাঝামাঝিতে খ্রিস্টধর্ম ছড়িয়ে দেয়ার জন্য স্কটিশ মিশনারি ডেভিড লিভিংস্টোন আফ্রিকায় পৌঁছান। প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে ১৮৫৫ সালে তিনি জলপ্রপাতটি আবিষ্কার করেন। রানী ভিক্টোরিয়া কে চিরস্মরণীয় করে রাখতে তিনি জলপ্রপাতটির নাম দেন ‘ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত’।


১৮৫৭ সালে লিভিংস্টোন তার ডায়েরীতে লেখেন,”ইংল্যান্ডের কেউ এই অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যকাব্য কল্পনাও করতে পারবে না। দেবদূতরা যখন এর আশেপাশে উড়ে, খুব সম্ভবত তারাও এই দৃশ্য দেখে চমৎকৃত হন।” সেই সময় থেকেই জলপ্রপাতটি ভিক্টোরিয়া ফলস নামে পরিচিতি পায়। এই জলপ্রপাতটি যে বিশেষ সৌন্দর্য্য বহন করে সেটি হল এখানকার জলীয়বাষ্পে সূর্যের আলো পড়ে রংধনুর সৃষ্টি হয়।

বিশ্বের তিনটি সেরা জলপ্রপাতের মধ্যে এটি অন্যতম। জলপ্রপাতটি প্রচণ্ড গর্জনশীল। প্রায় ৪০-৫০ কিলোমিটার দূর থেকে এর গর্জন শুনতে পাওয়া যায়। পানি পতিত হওয়ার সময় এর থেকে বাষ্প এবং ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়। এই ধোঁয়ার উচ্চতা প্রায় ৪০০ মিটার ছাড়িয়ে যায়। জলপ্রপাতটির নামকরণের অনেক আগে থেকেই এখানকার স্থানীয় আদিবাসীরা (চিতোংগা আদিবাসী ) এটিকে  'মোসি-ওয়া-তুনিয়া '  নামে ডাকে। 'মোসি-ওয়া-তুনিয়া ' অর্থ বজ্রের ধোঁয়া। জলপ্রপাতটির প্রচন্ড শব্দ এবং জলীয়বাষ্পের কারণেই এমন নাম দিয়েছে  চিতোঙ্গারা।  ২০১৩ সালে জিম্বাবুয়ে সরকার আদিবাসীদের দেওয়া এই  'মোসি-ওয়া-তুনিয়া ' নামকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। এই অঞ্চলের অধিবাসীদের কয়েকশো বছর ধরে জলপ্রপাতটি নিয়ে একধরণের ধর্মীয় ভীতি ছিল। এরা কখনো জলপ্রপাতের কাছাকাছি আসতো না। ১৯০৫ সালে বুলাওয়েতে রেলগাড়ি চলাচল শুরু হলে ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত জনপ্রিয়তা পায়। 


ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত উচ্চতায় ১০৮.৩ মিটার এবং প্রস্থে ১,৭০৩ মিটার। প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩৩,০০০ ঘনফুট পানি পতিত হয় এই জলপ্রপাত থেকে। এটি পৃথিবীর একমাত্র জলপ্রপাত যার প্রশস্ততা ১ কিলোমিটারের অধিক এবং উচ্চতা ১০০ মিটারের উপরে। প্রশস্ততা এবং উচ্চতার জন্য ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতকে পৃথিবীর সবচাইতে বড় জলপ্রপাত হিসেবে মনে করা হয়। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের সাথে তুলনা করলে ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত প্রায় দ্বিগুণ প্রশস্ত এবং দ্বিগুণ গভীর। ইউনেস্কো ১৯৮৯ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে জলপ্রপাতটিকে তালিকাভূক্ত করে। এর পরবর্তী বছর প্রায় ৩ লক্ষ লোক জলপ্রপাতটির সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে আসেন।

প্রতি বছর আড়াই লাখেরও বেশি পর্যটক এই জলপ্রপাতটি দেখতে ভীড় জমান। জিম্বাবুয়ের ভিক্টোরিয়া ফলস ন্যাশনাল পার্ক এবং জাম্বিয়ার মোজি-ওয়া-তুনিয়া ন্যাশনাল পার্ক ব্যাপক এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে। আশেপাশের বনে অ্যান্টিলোপ, হাতি, জিরাফ, জেব্রা, সিংহ, চিতা ইত্যাদি প্রাণীর বসবাস। পাহাড়ের চূড়ায় বাজপাখি, ঈগল আবাস গড়েছে। তবে জাম্বেজির নিম্ন নদী প্রবাহকালীন সময়ে পূর্বদিকের অংশ প্রায়শই শুষ্ক থাকে। জলপ্রপাতের উভয় অংশকে সংযুক্ত করতে ভিক্টোরিয়া ফলস (জাম্বেজি) সেঁতু নির্মাণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে রেলওয়ে, মোটরগাড়ী চলাচল করে। বর্তমানে এটি বহিঃবিশ্বের পর্যটকদের কাছে প্রধান আকর্ষণ হিসেবে রয়েছে