চাঁদের আলোয় শরীর ভেজানো কিংবা বৃষ্টিতে  মনের সুখে নেচে উঠতে চাওয়া মানব মনের এক অনন্য অনুভূতির নাম। সে অনুভুতিতে নাড়া দিয়ে কাউকে পাগল বলে সম্বোধন করা নিশ্চয় যাই না। তবু নানা অযুহাতে ধর্মের দোহাই দিয়ে একটা নির্দিষ্ট শতাংশ নারী সমাজের ওপর নির্যাতন করে পুরুষ শাসিত সমাজ। সেসব কাহিনী নিয়েই তৈরী হয় চিত্রনাট্য। আর তারই একটা "মোল্লা বাড়ির বউ"। জনপ্রিয় টিভি ধারাবাহিক নির্মাতা সালাউদ্দিন লাভলু ২০০৫ সালে মোল্লা বাড়ির বউ পরিচালনা করেন।


সংক্ষিপ্ত কাহিনী

হোতাপাড়া গ্রাম ২০০ বিঘা জমির মালিক “গাজী এবাদত মোল্লা” পরিবারের বসবাস। মোললার একমাত্র ছেলে “জোয়ান গাজী” ছোট বেলা থেকে এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে, সে পৃথিবীতে বাবা ছাড়া কোন কিছু বোঝেনা এমনকি বউকে ভালোবাসতে বোঝেনা। আর পুত্রবধু “বকুল” প্রকৃতির প্রেমে মগ্ন। তার সুখ, দুঃখ, আনন্দ, হাসি, কান্না, সব কিছু প্রকৃতিকে ঘিরে। প্রকৃতির সাথে তার রয়েছে গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক।

কিন্তু শ্বশুর গাজী সাহেব পুত্রবধুর প্রকৃতি প্রেমের ওপর বাধার দেওয়াল হয়ে ওঠেন। শুরু করেন নানা ধরনের অত্যাচার। নিজের ছেলের মাধ্যমে গাজী খবর পান  সংসারে নতুন অতিথি আসছে।  খবর পেয়ে খুব খুশি হয়ে বৌমার গলায় তাবিজ পরিয়ে দেন। বৌমা বকুলকে প্রকৃতির প্রেম ছিন্ন করে হামামখানা (গোসলখানা) বানিয়ে দেন। বকুল হামামখানায় না গিয়ে পুকুরে গোসল করতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে। এই ঘটনায় বকুলের পেটের সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। এরপরই বকুলের উপর শুরু হয় গাজীর অত্যাচারের আর এক নতুন অধ্যায়। বকুলকে জ্বীনে ধরেছে বলে জ্বীন ছাড়ানোর নামে ওঝাঁকে দিয়ে বকুলের উপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন।

এরকিছুদিন পরেও বকুলের প্রকৃতি আর গানবাজনার প্রতি ভালোবাসা না কমলে গাজী সাহেব ছেলের বিবাহের ব্যবস্থা করে পারুল নামের সৃষ্টিকর্তা ভক্তা এক তরুণীর সাথে। এভাবেই চলতে থাকে সিনেমার গল্প।

মোল্লা বাড়ির কুসংস্কারারের আড়ালে যত নির্যাতন

১। সিনেমার শুরুতে দেখা যাই, ইবাদত মোল্লা একজন ধার্মিক ব্যক্তি। কিন্তু তিনি ধর্মের আড়ালে নারীদের প্রতি নানা ধরনের বৈষম্যের সাথে তাল মেলান। এলাকাবাসী তাকে ওয়াজ-মাহফিলে প্রধান অথিতি করেন। কিন্তু সেখানে অস্তিত্বহীন হাদীসের কথা বলে সমালোচিত হন। নারীদের পড়াশোনা করা যাবে না, বাইরে বের হওয়া যাবেনা, শুধু স্বামীর শরীর টিপে দিতে হবে আর সেইসাথে সারা রাত ইবাদত করতে হবে। অথচ ইসলামে কোথাও বলা নেই যে মেয়েদের পড়াশোনা করা যাবে না।

২। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যে আমাদের অনেকে বিশ্বাস করে জীন-পরীর কারনে পেটের বাচ্চা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তার প্রতিফলনেই বোধহয় মোল্লা বাড়ির বউ সিনেমাতে এ অংশটি তৈরী হয়েছে। পুকুরে গোসল করতে গিয়ে শ্যাওলা আচ্ছাদিত সিড়িতে পা পিছলে পড়ে যাই বকুল। সাথেসাথে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা যাই তার পেটের সন্তান। এরপরে বাড়িতে ডাকা হয় ওঝা। সেই ওঝার মাধ্যমে নির্যাতন শুরু করা হয় বকুলের ওপর। অথচ ওঝার কোনো শক্তিই ছিল না জীন তাড়ানোর। সেটা আরো পরিষ্কার হয় সিনেমার দ্বিতীয়ার্ধে।

৩। বোস্টমী যখন বকুলকে গান শুনিয়ে বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে, তখনই এবাদত মোল্লা নানান ধরনের কথা বলে তাদের ধর্মের কেষ্ট ঠাকুরকে নিয়ে কটুক্তি করে যা বোস্টমীর জন্য অপমানজনক।

৪। বাউলমনা বকুলের বাবা বিশ বছর পর যখনমেয়েকে দেখতে আসে ইবাদত মোল্লা তার দোতারা ভেঙে ফেলে! অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। মেয়েকে তার বাবার সাথে কথা বলার অধিকারও ছিনিয়ে নেওয়া নেয় সিনেমারই একটা দৃশ্যপটে। ঘটনার ভয়বহতা রুপ নেই বকুলের বাবার মৃত্যু দিয়ে। সেসময়ে এবাদত মোল্লার একটি উক্তি হয়তো কারোই চোখ এড়ায় না - " মরলো তো মরলো আমার ঘরে এসেই "।

 


৫।  শুধুমাত্র খান্দানের প্রত্যাশা থেকেই মোল্লা ইবাদত গাজী তার ছেলে জোয়ান গাজীকে দ্বিতীয় বারের মতো বিবাহ দেবার সিদ্ধান্ত নেন। ইবাদত গাজী বিবাহের পরে নতুন বউ পারুলের  সামনে আগের বউকে খাটাশ বলে সম্বোধন করে।

 

তবে জোয়ান গাজীর দ্বিতীয় বিবাহের পরেই সিনেমার প্রেক্ষাপট যাই পাল্টে। নতুন বউ শ্বশুর ইবাদত গাজীকে নানাভাবে হেনস্থা করতে থাকে। যদিও প্রথমে ইবাদত গাজীর তেমন ইসলামিক জ্ঞান না থাকাই তিনি বুঝতে পারেননা। তবে সিনেমার শেষান্তে সেই ওঝার কবলেই ইবাদত গাজীকে পড়তে হয়। তিনি এতটাই হেনস্থা হন যে রাম দা দিয়ে জোয়ান গাজীর দ্বিতীয় স্ত্রী পারুলকে মারতে যান। তবে বকুলের হাতে প্রাণ দেন ইবাদত মোল্লা।

সময় পেরিয়ে গেছে অনেক। একবিংশ শতাব্দীরও দুই দশক পেরিয়ে গেছে। তবুও সমাজের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চোখ মেলে তাকালেই দেখা যাই ইবাদত মোল্লাদের। একের পর এক নারীর ওপর করা হয় নির্যাতন। আজও মেলেনা কোনো সমাধান।

পত্রিকা খুললেই দেখা যাই নারীদের ওপর ব্যভিচারের গল্প। প্রশ্নটা তাহলে রইলো ভাই তোমাদের কাছে হায় - এ সমস্যার শেষ কোথায় ?