মানুষ! একজন মানুষ কে আমরা তখনই প্রাধান্য দেয় যখন তার সৃষ্টির সৌন্দর্য ও তাতে জীবনের নান্দনিক প্রতিচ্ছবির প্রতিফলন একই রকম হয়।  ঠিক তেমনই একজন মানুষ কাজী নজরুল ইসলাম, যার গ্রহণযোগ্যতা আমাদের কাছে অনেক। যিনি মানুষকে শুধু মানুষ হিসেবেই চিনিয়েছেন।  ধর্ম বর্ণ জাত বংশের বেড়া জালে অাবদ্ধ করেননি। তাই তিনি বলেছেন - 'মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান'।  বাঙালীর হৃদয়ে তিনি বুনেছেন অসাম্প্রদায়িকতার বীজ, তাই পরিচিতি পেয়েছেন অসাম্প্রদায়িক মানবতার কবি হিসেবে।       দুখু মিয়া থেকে শুরু, নজরুল হয়ে দাগ কেটেছেন হাজারও ভক্তের হৃদয়ে আর এখন বিবিসির জরিপে তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালির মধ্যে ৩ নম্বরে স্থান পেয়েছেন।

বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম : অসাম্প্রদায়িক মানবতার কবি ।
নজরুল ইসলাম   ছবিঃ উইকিমিডিয়া  


কাজী নজরুল ইসলাম স্বাধীন বাংলাদেশে পেয়েছেন জাতীয় কবির মর্যাদা।  জাতীয় কবি ছাড়া তিনি বিদ্রোহী কবির খ্যাতিও অর্জন করেছেন। লেখালেখিতে নজরুল ছিলেন অসম্ভব রকম বিদ্রোহী স্বভাবের। তার বিভিন্ন লেখনীতে রয়েছে সেই বিদ্রোহের চিহ্ন। কিন্তু তার হঠাৎ করে বাংলা সাহিত্য এবং সংগীতজগতে আসাটা উল্কার মতো মনে হয়। তবে যেভাবেই সাহিত্য জগতে পদর্পন করুক তিনি আসলে ছিলেন সাহিত্য আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র। 
কাজী নজরুল ইসলামের লেখা যেমনই ব্যতিক্রমী তার জীবনের গল্পও তেমন বৈচিত্রময়।  সময়ের সাথে সাথে মানুষের অনেক পরিবর্তন হয়, কাজী নজরুলের এই পরিবর্তন সব থেকে বেশি প্রভাবিত করেছিল তার নামকে। দুখু মিয়া থেকে শুরু হয়েছিল তারপর নজর আলি, নজর আলি থেকে নজরুল এসলাম, নজরুল এসলাম থেকে নজরুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম থেকে কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী নজরুল ইসলাম থেকে হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম, এবং শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম হয়ে উঠলেন তিনি। 

জন্ম ও ছেলেবেলা 


বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম : অসাম্প্রদায়িক মানবতার কবি ।
ছেলেবেলার নজরুল
ছবিঃ উইকিমিডিয়া  

১৮৯৯ সালের ২৫ মে দুখু মিয়ার জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। দুখু মিয়া ছিলেন কাজী ফকির আহমদ এবং জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান। দুখু মিয়া যে পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন সেখানে শিক্ষা দিক্ষার তেমন কোন আধিক্য ছিলো না। তাছাড়া পরিবারটি ছিল আর্থিক ভাবে বেশ অসচ্ছল। বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম।  তাই তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। মক্তবেই তিনি  কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। যখন তার বয়স মাত্র নয় বছর তখন তার পিতা মারা যান । পিতার মৃত্যুতে যেন সবকিছু থেমে গেল।  পারিবারিক অভাব-অনটনের যেন ঘিরে ধরল। অভাবের কাছে হার মানতে হলো   শিক্ষাজীবনের।  তাই পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে মাত্র দশ বছর বয়সে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নেমে পরলেন । তখন স্থানীয় এক মসজিদে সম্মানিত মুয়াযযিন হিসেবে দায়িত্ব নিলেন তিনি। এই সুবাদে বেশ অল্প বয়সেই ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে  অভ্যস্থ হয়ে যান  যা পরবর্তীকালে তার সাহিত্যকর্মে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে।  এর মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনার চর্চা শুরু করেন।  তাছাড়া  কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে যেয়ে তিনি কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে প্রাথমিক  জ্ঞান লাভ করেন।  বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি একটি লেটো গানের দলে যোগ দেন।  তাই ঐ অঞ্চলের জনপ্রিয় লেটো কবি শেখ চকোর এবং কবিয়া বাসুদেবের লেটো ও কবিগানের আসরে নজরুল নিয়মিত অংশ নিতেন।

সাহিত্যে পদার্পন 

লেটো দলে থাকতেই নজরুলের সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। লেটো গানের দলেই তিনি অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। এখানে থেকেই তিনি বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন। একইসাথে তিনি বিভিন্ন হিন্দু ধর্মীয় শাস্ত্র-গ্রন্থ অধ্যয়ন করতে থাকেন। খুব কম  বয়সেই তিনি বেশকিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন যা তার নাট্যদলে পরিবেশিত হত। ১৯১০ সালে নজরুল লেটো গানের দল ছেড়ে দেন এবং পুনরায় পড়ালেখায় মনোনিবেশ করেন।  কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বেশি দিন পড়ালেখা করা সম্ভব হয়নি তার। তাই আবার তিনি কবিগানের দলে যোগ দেন। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। আসলে বিদ্রোহী কবিতার জন্যই নজরুল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়।

দাম্পত্য ও সৈনিক জীবন 

নজরুল একবার  কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানে এসে তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পরেন। এখানে প্রমীলা দেবীর সাথে তার পরিচয় হয় এবং তিনিই নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দাম্পত্য জীবনে তিনি চার সন্তানের জনক হন।
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে মাত্র আড়াই বছর সময় অতিবাহিত করেন । এই অল্প সময়েই তিনি বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।   কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন এই আড়াই বছরে।

পুরষ্কার ও সম্মাননা

বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে  বিশেষ অবদানের জন্য তিনি স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত হন । ১৯৭৬ কবিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্মানসূচক একুশে পদক প্রদান করা হয়। কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশর জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়। ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বাংলা সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার 'জগত্তারিণী স্বর্ণপদক' প্রদান করা হয় কবিকে । ১৯৬০ সালে ভারত সরকার কবিকে পদ্মভূষণে ভূষিত করেন।  এছাড়াও নজরুলের নামে বাংলাদেশ ও ভারতে রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও একাডেম।  তার লেখা 'চল চল চল' কবিতাটি বাংলাদেশের রণ সংগীত হিসিবে গৃহীত হয়েছে।

বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম : অসাম্প্রদায়িক মানবতার কবি ।
নজরুলের সমাধি  ছবিঃ উইকিমিডিয়া  


অসুস্থতা ও জীওবনাবাসন 

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। একটা পর্যায়ে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। চিকিৎসার জন্য তাকে লন্ডনে পাঠানো হয় এবং সেখানকার ডাক্তার রাসেল ব্রেইনের মতে নজরুলের রোগটি ছিল দুরারোগ্য তাই আরোগ্য করা ছিল অসম্ভব। অবশেষে ২৯ আগস্ট, ১৯৭৬ সালে মাত্র ৭৭ বছর বয়সে মারা যান।