অবিশ্বাস্য! অভাবনীয়! অকল্পনীয়! অতুলনীয়! অবিস্মরণীয়! ফেলুদাসমগ্রে লালমোহন বাবু নেপালের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বলা বিশেষণগুলোই যেনো বেন স্টোকসের বীরত্বকাব্যের সাথে একই সূত্রে গাথা। কে ভেবেছিল! কে ভেবেছিল! স্বয়ং বেন স্টোকস ও হয়তো না। তাইতো যেতে হবে একটু পেছনে।
৩ এপ্রিল,২০১৬
কলকাতার ইডেন গার্ডেনে বিশ্বকাপ টি-টুয়েন্টির ফাইনালে মুখোমুখি ইংল্যান্ড-ওয়েস্টইন্ডিজ। সে ম্যাচে ১৫৬ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে থাকা ওয়েস্টইন্ডিজের জয়ের জন্য শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ১৯ রান। ক্যাপ্টেন মরগান বল তুলে দিয়েছিলেন বেন স্টোকসের হাতে। স্ট্রাইকে থাকা কার্লোস ব্রাথওয়েট মারলেন টানা চার বলে চার ছয়। ইয়ান বিশপের কন্ঠে শোনা গেলো , "Carlos Brathwaite! Carlos Brathwaite , remember the name!"
সেদিন পিচের পাশে হাটুগেড়ে বসে পড়া স্টোকসকে মনে রাখেনি কেউ বা মনে রাখলেও হয়তো খলনায়ক হিসাবে গেঁথে গিয়েছিল সমর্থকদের হৃদয়ে। ক্রিকেট প্রেমীরা হয়তো সেদিনের কার্লোস ব্রাথওয়েট কিংবা ইয়ান বিশপের সেই বিখ্যাত উক্তি মনে রেখেছিল।
ইংরেজিতে প্রবাদ আছে ,"Life always provides you the second chance." হয়তো একারনেই বেন স্টোকস দ্বিতীয় সুযোগ পেলেন।বছর তিনক পরে। আরেকটা ফাইনাল । এবারের টা ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ।তবে বেনের দায়িত্ব এবার ব্যাটিংয়ে।
জুলাই ১৪,২০১৯
ক্রিকেটের মক্কা খ্যাত লর্ডসে নিউজিল্যান্ড আর স্বাগতিক ইংল্যান্ডের মধ্যকার ফাইনালের মাধ্যমে টুর্নামেন্ট শেষ হতে যাচ্ছে। নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন টসে জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয়। ক্যাপ্টেনের সিদ্ধান্ত যথার্থ প্রমাণ করে শুরুটা ভালো এনে দেয় দুই ওপেনার হেনরি নিকোলস আর মান্টিন গাপটিল। কিন্তু দলীয় ২৯ রানের মাথায় ওকসের বলে লেগ বিফোরের স্বীকার গাপটিল। দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে নিকোলস-উইলিয়ামসন ৭৪ রান যোগ করেন। দলীয় ১০৩ রানের মাথায় ভয়ানক হয়ে ওঠার আগে প্লাঙ্কেটের বলে পুরো টুর্নামেন্টে অসাধারন খেলা উইলিয়ামসনের বিদায়। হেনরী নিকলস পঞ্চাশ তুলে নিলেও ৫৫ তেই কাঁটা পড়েন দলীয় ১১৮ রানে সেই প্লাঙ্কেটের বলে। টম লাথামের ৪৭ এ ভর করে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারানো নিউজিল্যান্ড সংগ্রহ করে ৮ উইকেটে ২৪১।বিশ্বকাপ ডিসাইডারে ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ২৪২।
২০১৫ বিশ্বকাপের পরের ইংল্যান্ড এক বদলে যাওয়া দল। পরের চার বছরে চেজিংয়ের রাজা বনে যাই ইংল্যান্ড এর এই দলটা। এ যেনো এক নতুন ইংল্যান্ড। বিশ্বকাপের আগে অ্যান্ড্রু স্ট্রোস তো বলেই দিলেন, "বিশ্বকাপে ৫০০ রান চেজ করেও জেতা সম্ভব হবে"। সে হিসাবে ২৪২ তেমন স্কোর না হলেও বিশ্বকাপ ফাইনালের একটা চাপ তো থেকেই যাই। তাছাড়া পুরো টুর্নামেন্টেই ২৫০ এর আশেপাশের স্কোরই ফাইটিং স্কোর হয়ে গিয়েছিল।
২৪২ এর লক্ষ্যে আর ইংল্যান্ড এর ৪৪ বছরের আক্ষেপ ঘুচাতে ব্যাট হাতে নামলেন জেসন রয় আর বেয়ারস্টো। বলে রাখা ভালো পুরো টুর্নামেন্টে ম্যাচে সবথেকে বেশী চাপ তৈরী করতে পেরেছিল এ ওপেনারদ্বয়। ভালোই শুরু করেছিল রয়-বেয়ারেস্টো। প্রথম পাঁচ ওভারে ২৪ রান তুলে নিয়েছিল। তবে ২৮ রানের মাথায় ইংল্যান্ড এর প্রথম পেরেক ঠুকে দেয় নিউজিল্যান্ড পেসার ম্যাট হেনরী। ১৭ রান করে প্যাভিলিয়নে ফেরে জেসন রয়।এরপর ৮৬ রানের মধ্যে একেএকে রুট,বেয়ারেস্টো,মরগান ফিরে যান। ২৩ ওভারে ৮৬ রানের মাথায় যখন মরগান চতুর্থ ব্যাটসম্যান হিসাবে ফিরে গেলেন তখন হয়তো অনেকেরই মনে হচ্ছে ইংল্যান্ডের ৯২ ওয়াল্ডকাপের দুঃখস্মৃতি আবারো ফিরে আসছে।এরপরে নামেন জস বাটলার।বাটলার নামতেই খেলার চাল আবার পাল্টে যাই। স্টোকস আর বাটলার মিলে গড়ে তোলেন ১১০ রানের এক মহামূল্যবান জুটি। ম্যাচশেষে স্টোকস বলেন , ‘জস আর আমি দুজনই জানতাম, যতটা পারি শেষ পর্যন্ত যদি ব্যাট করে যেতে পারি নিউজিল্যান্ড চাপে পড়ে যাবে।’ চাপে নিউজিল্যান্ড পড়েও গিয়েছিল। কিন্তু ফিরে এসেছিল দারুণভাবে। বাটলার ও ক্রিস ওকসকে দ্রুত ফিরিয়ে দিয়ে। নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে যখন সমীকরণ ক্রমেই অসম্ভব হয়ে উঠছে আর তখনই হাল ধরলেন স্টোকস।ওকস আউট হলে ইংল্যান্ড এর প্রয়োজন ২৪ বলে ৩৯ আর প্লাঙ্কেট যখন আউট হলেন,তখন প্রয়োজন ৯ বলে ২২। অসম্ভব না হলেও নিঃসন্দেহে কঠিন থেকে কঠিনতর।নিশামের চতুর্থ বল স্টোকস মিডউইকেটে মারলেন ভাসিয়ে। বোল্ট বল ঠিকই লুফে নিলেন। কিন্তু টালমাটাল অবস্থায় বল হাতেই সীমানা ছুঁয়ে ফেলে তার পা। ইংল্যান্ড পেয়ে যাই ৬ রান। পরের বলে সিংগেল নেয় স্টোকস। ওভারের শেষ বলে আউট জোফরা আর্চার।
ম্যাচের নাটক জমে ওঠে শেষ ওভারে। ইংল্যান্ডের শেষ ওভারে প্রয়োজন ১৫। স্ট্রাইকে বেন স্টোকস।নিউজিল্যান্ড ক্যাপ্টেন উইলিয়ামসন শেষ ওভার তুলে দিলেন ট্রেন্ট বোল্টের হাতে। বোল্টের প্রথম ২ বলে কোন রান নেই। বোল্ট যেন প্রমাণ করতে বসলেন , অধিনায়কের তার হাতে বল তুলে দেওয়া যথার্থ। ইংল্যান্ডের প্রয়োজন শেষ ৪ বলে ১৫। অনেকেরই মনে হতে শুরু করেছে বিশ্বকাপ স্বপ্ন বোধহয় শেষ। সে স্বপ্নে একটুখানি আশার প্রদীপ হয়ে নিভুনিভু করে জ্বলছে লাখো ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে বেন স্টোকস । আর তখনই ওভারের তৃতীয় বলে স্টোকস হাটু গেড়ে মিডউইকেটের ওপর দিয়ে মারলেন ছক্কা।
৩ বলে প্রয়োজন ৯! ঠিক তখনই ঘটলো ম্যাচের সবথেকে নাটকীয় ঘটনা। লেগ সাইডে বল পাঠিয়ে স্টোকস ছুটলেন দুই রানের জন্য। মার্টিন গাপটিলের থ্রো স্টোকসের ব্যাট ছুঁয়ে সোজা মাঠের বাইরে । ইংল্যান্ড পেয়ে যায় আরো ৬ রান। এনিয়ে খানিকটা খটকা ছিল মাঠেও, বেন স্টোকস সাথে সাথে হাত উঠিয়ে জানান দেন যে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যাট বলে লাগাননি।প্রথমে দৌঁড়ে নেয়া দুই রানের সাথে যোগ হয় ওভারথ্রোতে আসা চার, মোট রান হয় ছয়।
বিশ্বকাপ জিততে ইংল্যান্ড এর প্রয়োজন শেষ দুই বলে ৩ রান। এবার পঞ্চম বলে লং-অফে বল ঠেলে দিয়েই স্টোকস দৌড়ালেন ২ রানের জন্য।কিন্তু স্যান্তনারের থ্রোতে আদিল রাশিদ রানআউট।ফলে শেষ বলে লাগবে আরো দুই রান। এবার শেষ বলে লং-অনে ঠেলে দিয়ে স্টোকস আবার ২ রানের জন্য ছুটলেন। কিন্তু এবার মার্ক উড রান আউট। ৮৯ করে অপরাজিত থাকলেন স্টোকস।
৫০ ওভারের ম্যাচ শেষ হলো টাইড। একেএকে সবাই যখন আউট হয়ে গেলেন প্যাভিলিয়নে , স্টোকস এক প্রান্ত আগলে রেখে দলকে অন্তত আরো একটা সুযোগ এনে দিল বিশ্বকাপ জেতার। ফাইনাল ডিসাইডার হবে সুপার ওভার।
প্রায় ৩ ঘন্টা ব্যাটিং এর পরও ক্লান্তি তাকে ছুঁতে পারেনি। জস বাটলারকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাটিংয়ে নামলেন স্টোকস । নিউজিল্যান্ড ক্যাপ্টেন উইলিয়ামসন সুপার ওভারের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন ট্রেন্ট বোল্টের হাতে। প্রথম বলে আউটসাইড এজে স্টোকসের ব্যাট থেকে আসে ৩ রান। পরের বলে বাটলার সিংগেল নেয়।তৃতীয় বলে মিডউইকেট দিয়ে স্টোকসের চারের মার। প্রথম ৫ বলে ইংল্যান্ড করতে পারে ১১ রান। শেষ বলে বাটলারের ৪ এর মারে ইংল্যান্ড পেয়ে যাই সুপার ওভারে ১৫ রান।
১৬ রানের টার্গেটে নিউজিল্যান্ডের হয়ে নামলেন জিমি নিশাম আর গাপ্টিল। আর সুপার ওভারে ইংল্যান্ড অধিনায়ক বল তুলে দেন জোফরা আর্চারের হাতে। প্রথম বল ওয়াইড ইয়োর্কার করতে গিয়ে দিয়ে ফেললেন ওয়াইড।৬ বলে প্রয়োজন ১৫।পরের বলে লং-অফে বল ঠেলে নিলেন আরো দুই রান। ৫ বলে প্রয়োজন ১৩ রান! দ্বিতীয় বলে নিশাম মিডউইকেটের উপর দিয়ে মারলেন লম্বা এক ছক্কা এরই সাথেসাথে ইকুয়েশন হয়ে গেলো ৪ বলে ৭।
ফাইনালের উত্তেজনা ঠিক কতটা কাজ করে তা বোঝা যায় আর্চারের তৃতীয় বল থেকে। নিশাম বল লেগ সাইডে ঠেলে দিয়ে দৌড় শুরু করেছেন। এমন সময় মিস ফিল্ড। যোগ হলো আরো ২ রান । শেষ তিন বলে প্রয়োজন ৫। পরের দুই বলে আর্চার এর কামব্যাকে নিউজিল্যান্ড এর রানের খাতায় যোগ হলো ৩ রান। শেষ বলে প্রয়োজন ২ রান। স্ট্রাইকে মার্টিন গাপটিল।মিডউইকেটে বল ঠেলে দিয়ে দৌড় শুরু করলেন দুই রানের জন্য। জেসন রয় থ্রো করলেন কিপিং এন্ডে। জস বাটলার স্টাম্প ভেঙে দিলেন। রান আউট! মার্টিন গাপটিল রানআউট। একেক জন একেক দিকে ছোটা শুরু করলেন। ইংল্যান্ড বিশ্বচ্যাম্পিয়ন । সুপার ওভার টাই হওয়ার পরেও আইসিসির নিয়মানুসারে বাউন্ডারিতে ২৬-১৭ ব্যবধানে চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড। ম্যান অব দ্যা ফাইনাল বেন স্টোকস!
ইংল্যান্ড এর বিশ্বকাপ জয়ের মাধ্যমে বেন স্টোকস নিজের পাঁপমোচন করেন। তিনি মনে করিয়ে দেন ইতালির বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলার পাওলো রসির কথা। ১৯৮২ তে ইতালিকে বিশ্বকাপ জেতানোর আগে ম্যাচ পাতানো কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে নির্বাসিত হন জাতীয় দল থেকে। দলে ফিরে রসি বিশ্বকাপে ৬ গোল করে গোল্ডেন বুটের সাথে, গোল্ডেন বলটাও করে নেন নিজের। স্টোকস হয়তো বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হননি,কিন্ত পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে খেলেছেন অনবদ্য।বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই সাউথ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ধরেছেন অবিশ্বাস্য এক ক্যাচ!নাসের হুসাইনকে বলতে বাধ্য করেছেন, "You can not do that Ben Stokes." বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে করেছেন ৪৬৫ আর মাঝেমাঝে তার করা মিডিয়াম ফাস্টে পেয়েছেন ৭ উইকেট। ইডেনগার্ডেনে শেষ ওভারের কলঙ্ক হয়তো কিছুটা হলেও কমাতে পেরেছেন। হয়তো নিশ্চিন্তে ইলেকট্রনিক হিটার অন করে ঘুমুতে পেরেছেন কোন এক শীতের রাতে কিংবা স্যাম্পেইনে চুমুক লাগিয়েছেন আরাম করে। বিশ্বকাপের কিছুদিন পর , অ্যাশেজে হেডিংলিতে অনবদ্য এক সেঞ্চুরি করে শেষ উইকেটে ম্যাচ জেতান। কি এক অবিশ্বাস্য-অতুলনীয় গ্রীষ্মই না কাটালেন বেন স্টোকস!
0 Comments
Post a Comment