একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ এবং সে দেশের উন্নতির জন্য একজন  বিনয়ী মার্জিত ও শিক্ষিত মানুষের অবদান ঠিক কত টুকু হতে পারে তা আমরা স্যার আনিসুজ্জামানের মাধ্যমে উপলব্ধি করতে পারি।  বাংলাদেশ কথাটি বলতে গেলেই বলতে হয় স্যার আনিসুজ্জামানের কথা।  কেননা  ষাটের দশক থেকেই বাঙালি জতীর জন্য  শুরু হয়েছিল তার আত্মঅঞ্জলি। স্বাধীন বাংলার জন্য তিনি ছিলেন আশীর্বাদ ।  ১৯৫২ তে ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর  গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন এবং ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি । তিনি  মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এবং মুক্তিযুদ্ধের পরে সরকার কর্তৃক গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন।  

একজন আনিসুজ্জামান, একজন কিংবদন্তী
ছবিঃ উইকিমিডিয়া


জন্ম ও শিক্ষাজীবন

 ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটে জন্ম আনিসুজ্জামানের । পিতা এ টি এম মোয়াজ্জেম এবং মা মা সৈয়দা খাতুনের চতুর্থ সন্তান ছিলেন তিনি। 
আনিসুজ্জামানের শিক্ষাজীবনের শুরু কলকাতার পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে । এখানে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর বাংলাদেশে চলে আসেন তিনি এবং খুলনা জেলা স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন। খুলনাতেও বেশিদিন থাকেননি তিনি।  এক বছর পরেই পরিবারের সাথে ঢাকায় চলে আসেন । ১৯৫১ সালে প্রিয়নাথ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে স্নাতক ও ১৯৫৭ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

কর্মজীবন ও সাফল্য

স্যার আনিসুজ্জামানের কর্মজীবন সহ অন্যান্য প্রতিটা ক্ষেত্রেই তিনি সফল ছিলেন ৷  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু হয় । পরবর্তীতে তিনি ১৯৬৯ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন  ভারত গমন করে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন 'বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি'র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি যুদ্ধকালীন গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন।  ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পে অংশ নেন।
১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন।  ২০০৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর পুনরায়  সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে আবার যোগ দেন । তিনি মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। তিনি নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করন কিছুদিন। ত্রৈমাসিক পত্রিকা যামিনী এবং বাংলা মাসিকপত্র কালি ও কলম-এর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

একজন আনিসুজ্জামান, একজন কিংবদন্তী
ছবিঃ উইকিমিডিয়া

পুরস্কার ও সম্মাননা

স্যার আনিসুজ্জামান তার ভালো কাজের জন্য দেশে সহ দেশের বাইরের ও অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন।  শিক্ষাক্ষেত্রে অনন্য অবদানের জন্য  তিনি ২০১৯ সালে খান বাহাদুর আহছানউল্লা স্বর্ণপদক লাভ করেন। ২০১৮ সালে  বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদক লাভ করেন।  ২০১৭ সালে  বিপুলা পৃথিবী বইয়ের জন্য আনন্দবাজার পত্রিকা কর্তৃক  আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হন।  ২০১৫ সালে তিনি সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক  স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন।  ২০১৪ সালে শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ভারত সরকার পদ্মভূষণ পদক প্রদান করে। ২০০৫ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি. লিট. ডিগ্রি লাভ করেন।  ১৯৮৫ সালে তিনি শিক্ষায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একুশে পদক লাভ করেন।  ১৯৭০ সালে প্রবন্ধ-গবেষণায় অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি থেকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
এছাড়াও দাউদ পুরস্কার,  আনন্দ পুরস্কার, ইন্দিরাগান্ধী স্মারক, শরত্চন্দ্র স্মারক, নেতাজী স্মারক ইত্যাদি লাভ করেন৷   

জীবনাবসান

স্যার আনিসুজ্জামনারে মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারিয়েছে এক উজ্বল নক্ষত্র। বাংলাদেশের জন্ম থেকে এখন পর্যন্ত নিরলস সেবা দিয়ে চলতি বছরের  ১৪ ই মে ৮৩ বছর বয়সে ঢাকার একটি হাসপাতালে পরলোক গমন করেন।  বাংলাদেশের নাম বলতে গেলে তাই আনিসুজ্জামান স্যারের কথা মনে আসবেই।  শিক্ষা সংস্কৃতি আর গবেষণায় তিনি যে পদচিহ্ন এঁকেছেন তা অনুসরনিয়।