ছবিঃ উইকিমিডিয়া |
"তারে জামিন পার" সিনেমা দেখেছেন? সে সিনেমার "ইশান আওয়াস্তি" কে মনে আছে? সেই ছেলেটি যে কিনা স্কুল ফাকি দিয়ে মাছ, ঘুড়ি আর পাখি হয়ে ঘুরে বেড়াতো। মনে রেখেছেন কি?
বলা হয়ে থাকে সিনেমা নাকি জীবনেরই প্রতিফলন। জীবন থেকেই নাকি সিনেমার সৃষ্টি!চিত্রা নদীর পাড় ঘেসে বড় হওয়া নড়াইল শহরের এক কিশরের জীবন কাহিনী তো সে কথায় বলে। ১৯৮৩ সালের ৫ই অক্টোবর বাবা গোলাম মর্তুজা আর মা হামিদা মর্তুজার কোলজুড়ে জন্ম নেয় আদরের কৌষিক। কৌষিকের "কৌষিক" নামটা আসে সেসময়ে ইন্ডিয়া তে কৌষিক চ্যাটার্জি নামে একজন উপস্থাপকের নাম থেকে। ছোটবেলায় বাউন্ডেলে স্বভাবের কৌষিকের দিনের বেশীর ভাগ সময় কাটতো চিত্রার বুকে সাতার কেটে,বন্ধুদের সাথে এক গাছ থেকে অন্য গাছে উঠে। তাইতো ছোটবেলায় লোকে তাকে ডাকতো "তুলসী বাগানের টারজান" নামে।
তুলসী বাগানের টারজান বা আদুরে কৌষিক কে জানেন?জানেন হয়তবা! যে কিনা বিশ্বদরবারে নিজেক মাশরাফী বিন মর্তুজা হিসাবে চিনিয়েছেন।কিন্তু অনেকেরই আজও অজানা সেদিনের কৌষিক কিভাবে আজকের মাশরাফী হয়েছে?কেমন করেই বা এলো জাতীয় দলের ছায়াতলে?
ছবিঃ উইকিমিডিয়া |
২০০১ সালের কথা! হঠাৎ করেই জীবনের পালা বদল। সবে কৈশর পার করে যৌবনে পা দেওয়া ছেলেটি আজ জাতীয় দলের রাডারে। অভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন আন্তজার্তিক ক্রিকেটে। শখের বসে বন্ধুদের সাথে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ক্রিকেট খেলে বেড়ানো কৌষিকের জাতীয় দলে আসার কাহিনী জানতে যেতে হবে আরেকটু পেছনে।
তখন ২০০০ সালের শুরু হয়েছে মাত্র, ঢাকায় শুরু হয়েছে অনুর্ধ্ব-১৭ বিভাগীয় চ্যাম্পিয়নশিপ। "খুলনা টাইগার্স " নামের এক দলের হয়ে খেলতে নামলেন নড়াইল শহরের এক বাউন্ডেলে কৌশিক যে কিনা বোলিংয়ের সাথে করতে পারে মারকাটারি ব্যাটিংটাও। পারফর্ম করলেন নিজের মতো করেই।এর কিছুদিন পর ২০০১ সালের দিকে ঢাকায় গেলেন অনুর্ধ্ব-১৭ এর জাতীয় দলের ট্রায়ালে !টিকলেন সেখানে! একই বছরেই জায়গা হলো অনুর্ধ্ব-১৯ এর জাতীয় দলে।
ছবিঃ উইকিমিডিয়া |
এরপরের গল্পটা অনেকটা স্বপ্নের মতো!হঠাৎ করেই সুযোগ হয় জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে সিরিজের দলে।সেবছর অক্টবরে জিম্বাবুয়ে আসে বাংলাদেশে। আর নভেম্বরের শীতের সকালে টেস্ট অভিষেক হয় সেসময়ের তরুন মাশরাফীর। প্রথম ম্যাচেই ঝড় তুলেছেন গতির । নিজের প্রথম উইকেট হিসেবে তুলে নিয়েছিলেন গ্রান্ট ফ্লাওয়ারকে। সেই সাথে হয়ে যান,বিশ্বের বিরল ক্রিকেটারদের একজন যারা কিনা প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট না খেলেই,খেলে ফেলেছেন টেস্ট ক্রিকেট।
সেবছর বিসিবি পেস কনসালটেন্ট হিসাবে উড়িয়ে এনেছিলো ক্যারিবিয়ান গ্রেট অ্যান্ডি রবার্টসকে। সেসময়ের সম্ভবনাময় পেসারদে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দুজন তরুন তার নজর কেড়ে নেয়।একজন তালহা জুবায়ের ,অন্যজন মাশরাফী!মাশরাফীর ব্যাপারে বোর্ডকে বলে যান,"তোমরা ওর আলাদাভাবে যত্ন নিও। আর মাশরাফীকে বলেন,"তোমাকে তোমার দেশ ডাকছে!তুমি অনেক বড় ফাস্ট বোলার হবে,শুধু শরীরের যত্ন নিও।"
মাঝে একবার "এ" দলের হয়ে গিয়েছিলেন ভারত সফরে। সেখানে মুম্বাই এর সাথে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের মরা উইকেটেও গতির ঝড় তুলেছিলেন। সেম্যাচে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানের হেলমেটের গ্রিল ভেঙে ফেলেন গতির ঝড় তুলে।যা দেখে ঠাট্টার সুরে বলেছিলো,"তোমাদের কৌষিককে রেখে যাও এখানে"। সেসময়ের ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসক চন্দ্রকান্ত গুলাবরাও বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার দিপু রায়কে বলেন,"তোমরা অনেক বড় সম্পদ পেয়েছো,সে একদিন বিশ্ব কাঁপাবে ।"
এভাবে শুরু হয়েছিলো একজন কৌষিক থেকে মাশরাফী হওয়ার গল্প। তরুন বয়সে মাশরাফীর করা ১৪৫ গতির বল যেনো তারই শহরের এসএম সুলতানের এক একটি শিল্প।
ভারতের সাথে "এ" দলের হয়ে খেলে আসার সময় পিঠে হালকা ব্যাথা ছিল! পিঠে ব্যাথা নিয়ে খেললেন জিম্বাবুয়ে সিরিজ ও। পিঠের ব্যাথা নিয়েই আবার পাড়ি জমালেন নিউজিল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। খেললেন প্রথম টেস্ট ও! এরপরের টেস্ট ও খেললেন কোচ ট্রেভর চ্যাপেল ও ফিজিও জন গ্লস্টারের অনুরোধে।ফলশ্রুতিতে পড়তে হলো জীবনে প্রথম বারের মতো ইন্জুরীতে।
ছবিঃ উইকিমিডিয়া |
এরপরের গল্পগুলো হতাশার! ইন্জুরী আর মাশরাফীর বন্ধুত্বের। কিন্তু মাশরাফী বলেই হয়তো বারবার ফিরে এসেছেন। নিউজিল্যান্ড থেকে দেশে ফেরার কিছুদিন পরেই যেতে হয় ভারতের ব্যাঙ্গালুড়ুতে।সেখান থেকে দেশে ফিরে ডাক্তারদের কথামতো পুনর্বাসনের কাজ শুরু করেন। করতে থাকেন ব্যায়াম আর স্কিপিং। স্কিপিং করতে যেয়ে হঠাৎ একদিন দুর্ঘটনার শিকার হন।দড়ি পেচিয়ে পড়ে যান!তখন সাময়িক ব্যাথা পেলেও পরে ব্যাথা কমে যাওয়ায় কেউ কিছু মনে রাখেনি। পরেরবার পিঠের ব্যাথার ফলোআপ দেখাতে গিয়ে এমআরআই করালে ধরা পড়ে লিগামেন্ট ছিড়ে গেছে।
সেই থেকে শুরু!শুরু হয়েছে ইন্জুরীর সাথে নতুন লড়াই। নিজের ভালো সময় যখনই এসেছে ,নতুন করে আবারো ইন্জুরীতে পড়ছেন। ২০০৯ সাল ! সবে ক্যাপ্টেন হয়েছেন! ওয়েস্টইন্ডিজের সাথে টেস্টের দ্বিতীয় দিনেই আবার ইন্জুরীতে।২০১১ সাল ! দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ! আবার ও আরেকটা ইন্জুরী। এবার পারলেন না দেশের মাটিতে হওয়া বিশ্বকাপে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে। প্রকাশ্যে কাঁদলেন আর কাঁদালেন কোটি ভক্তকে।
ইন্জুরী থেকে বারবার ছিটকে গেছেন। দেশের হয়ে আবার ফিরেছেন। ২০১৪ সালে মুশফিককে সরিয়ে আবার ও হয়েছেন দেশের ক্যাপ্টেন। হয়েছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা অধিনায়ক। ক্যাপ্টেন হিসাবে ওয়ানডেতে দলকে এনে দিয়েছেন অর্ধশত জয়। নিজে নিয়েছেন ক্যাপ্টেন হিসাবে ওয়ানডেতে ১০০ উইকেট। সেই সাথে ২০১৫ এর বিশ্বকাপে দলকে নিয়ে গেছেন প্রথমবারের মতো কোয়ার্টারফাইনালে,২০১৭ এর চ্যাম্পিয়নস ট্রফি তে সেমিফাইনালে। ২০১৬ আর ১৮ তে খেলেছেন এশিয়া কাপের ফাইনালে। এতোকিছুর পরেও শুধু শিরোপা হাতে এসে ধরা দিচ্ছিলো না ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাসটিকের। সে আক্ষেপের অবসান ঘটে ২০১৯ সালে এসে। সে বছর আয়ারল্যান্ড ,ওয়েস্টইন্ডিজ আর বাংলাদেশকে নিয়ে আয়োজিত ট্রাইনেশনের শিরোপা ঘরে তোলে মাশরাফীর বাংলাদেশ। সব অপ্রাপ্তি মুছে যায় এক নিমিষে। সিরিজ জিতিছেন ভারত-পাকিস্তান -সাউথ আফ্রিকার মতো দলের সাথে।
ছবিঃ উইকিমিডিয়া |
ডেভ হোয়াটমোরের পাগলা মাশরাফী কোন বাধা মেনে চলে না।তিনি চলেন তার মতো করে।অস্ট্রেলিয়ান ডাক্তার ডেভিড ইয়াংয়ের মতে," চল্লিশের পরে পঙ্গু হয়ে যেতে পারে মাশরাফী"। তবু তিনি খেলা চালিয়েছেন তার মতো করে। ইন্জুরীতে পড়ে দলের বাইরে গেছেন কিন্তু মাশরাফী ফিরে এসেছেন বারবার নিজের মতো করে। ফেরেন বীরের বেশে। এ যেনো তারই শহরের বীরশ্রেষ্ঠ নুর মোহাম্মদের বীরের ছোয়া থেকে পাওয়া জীবনীশক্তি।
আঠারো বছরের ক্যারিয়ারে স্মৃতি আছে অনেক। বন্ধু রানার মৃত্যুতে কেঁদেছেন হাউমাউ করে। রানার মৃত্যৃকে স্মরনীয় করে রাখতে ভারতকে "ধরে দিবানে" বলে হুংকার দিয়েছেন। উপড়ে ফেলেছেন শেবাগদের উইকেট। ভালো খেলোয়াড়ের সাথে নিজেকে গড়ে তুলেছেন ভালো মানুষ হিসাবে।যখন যেভাবে পেরেছেন,মানুষকে সাহায্য করেছেন। আইপিএল থেকে ফিরে অর্ধেক টাকা রানার পরিবারকে দিয়েছেন,বন্ধু রাসেলের পাশে দূর্দিনে দাড়িয়েছেন।
সবকিছু পেরিয়ে ২০০৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপে এক তরুনের ছবি ভেসে ওঠে। সাউথ আফ্রিকার সাথে ম্যাচে প্রথম বল করতে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দিয়ে ফেললেন লম্বা এক ওয়াইড। হ্যা, এটাই সম্ভবত আমাদের মাশরাফী। আমাদের আবেগপ্রবণ মাশরাফী।
0 Comments
Post a Comment