ডিনিস আভেইরো আর মারিয়া আভেইরো কে চেনেন?ডিনিস পেশায় ছিলেন ফান্ঞ্চল পৌরসভার একজন মালি আর মারিয়া ছিলেন অন্য সবার মতো গৃহিণী । কিংবা তাদের কোল জুড়ে আসা ডস সন্তোস আভেইরো কে চেনেন?

বাবা ডিনিস ছিলেন অ্যামেরিকার ৪০তম প্রেসিডেন্ট  রোনাল্ড রিগানের একনিষ্ঠ ভক্ত।তাই তো ১৯৮৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি  ডেনিস-মারিয়ার কোলজুড়ে আসা সন্তানের নাম রাখলেন রোনালদো  ডস সন্তোস আভেইরো যিনি পরবর্তীতে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো বা সিআর সেভেন নামে পরিচিত ।পর্তুগালের মাদেইরা শহরে  বেড়ে ওঠা শিশু ডস সন্তোসের।থাকতেন   টিনের চালের বাড়িতে বাবা-মা আর ভাই হুগো এবং বোন ইলমা ও লিলিয়ানাকে নিয়ে।

ডস সন্তোস থেকে রোনালদো; এক মহা কাব্যিক আখ্যান


অন্য সবার মতো তার বাবা-মা ও চেয়েছিলো ছেলে স্কুলে যাবে ।পড়াশোনা করবে। কিন্তু স্কুল শিক্ষিকার অপমানজনক কথা সহ্য করতে না পেরে চেয়ার ছুড়ে মেরেছিলেন শিক্ষিকার দিকে।ফলাফল বহিষ্কৃত হতে হয় স্কুল থেকে।এরপর আর স্কুলে ফেরা হয়নি তার।ফুটবলের সাথে তার প্রেম শুরু হয়েছিলো অতি অল্প বয়সেই।তাই এরপরে ফুটবলেই মনোযোগী হন রোনাল্ডো।

মাত্র তিন বছর বয়সেই ফুটবল খেলা শুরু করেন। ছয় বছর বয়সেই স্কুলের  হয়ে ফুটবল খেলেন। আট বছর বয়সে "আন্ধারিনহা" তে নাম লেখান।মাদেইরা শহরের সব থেকে বড় ক্লাব  "ন্যাসিওনাল" ক্লাবে খেলার সুযোগ হয় মাত্র ১২ বছর বয়সেই। সেসময়ে কোন  ম্যাচে গোল বা অ্যাসিস্ট করতে না পারলে সারা দিন-রাত কেঁদে কাটাতেন  বলে তার মা তাকে "Crying Baby" বলে ডাকতেন।ছোটবেলায় তার প্রিয় ক্লাব ছিলো বেনফিকা যদিও বেনফিকার হয়ে কখনো খেলা হয়ে ওঠেনি তার।১২ বছর বয়সে ন্যাসিওনালে দারুন খেলার সূত্রে চোখে পড়েন বেনফিকার প্রতিদ্বন্দ্বী এবং পর্তুগালের অন্যতম সেরা ক্লাব স্পোর্টিং লিসবন।

ডস সন্তোস থেকে রোনালদো; এক মহা কাব্যিক আখ্যান
ছবিঃ উইকিমিডিয়া


স্পোর্টিং লিসবন (১৯৯৭-২০০৩)


স্পোর্টিং লিসবনের বি দলের হয়ে খেলার সুযোগ হয়।সেসময় প্রথমবারের মতো মা-বাবাকে ছেড়ে আসা রোনালদোকে সমর্থনের জন্য তার মাকে সাথে থাকার অনুমতি দেয় ক্লাব কতৃপক্ষ।মাঝে মাঝে ভাগ্য বিজয়ীদের সাথে প্রতারণা করে।রোনালদো এর বাইরে নয়।মাত্র পনের বছর বয়সে ধরা পড়ে হৃদরোগ।সেখানকার ডাক্তাররা তার বাবা-মা কে স্পষ্টভাবে বলে দিলেন, করতে হবে অস্ত্রপাঁচার কিন্তু সফল হওয়ার সম্ভবনা একেবারে নেই বললে চলে। হয় ফুটবল ছেড়ে দাও না হয় অস্ত্রপাঁচার করাও -পথ বেছে নিতে হবে দুটি থেকে যেকোন একটি।


রথী-মহারথীরা  খাদের কিনারা থেকে বারবার ফিরে আসে ।অস্ত্রপাঁচার করালেন!ডাক্তাররা সফল হলেন!২০০১ সালের শেষর দিকে মাঠে ফিরলেন রোনালদো।অনুশীলন শুরু করলেন।২০০২-০৩  মৌসুমে খেললেন স্পোর্টিং লিসবনের মুল একাদশে।মাঠের খেলায় দেখানো শুরু করলেন নানা ভেল্কিবাজি ।যা দেখে নজর কেড়েছিলেন  লিভারপুল আর আর্সেনালের মতো দলগুলোর।

২০০৩ সালের গ্রীষ্মে নজর কাড়েন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের।সেবার লিসবনে "স্তাদিও জোসে এলভালাদে স্টেডিয়াম "  উদ্বোধনের জন্য আয়োজিত খেলায় স্পোর্টিং  সিপি ৩-১ গোলে ম্যান ইউকে হারায়।রোনালদোর দুই উইংয়ে খেলার সক্ষমতা দেখে ফার্গুসন বলেন,"রোনালদো তার দেখা সময়ের সেরা ইয়াং প্লেয়ার"।আর মৌসুম শেষে ১২.২৪ মিলিয়ন পাউন্ডে রোনালদো পাড়ি জমাই ম্যানচেস্টারের ওল্ডট্রাফোর্ডে!

ম্যান ইউ (২০০৩-০৯)

ম্যানইউ যাত্রা শুরু হয়েছিলো এক স্বপ্নের মতো।স্পোর্টিং সিপি তে রোনালদো পরতেন ২৮ নাম্বার জার্সি।রোনালদো চেয়েছিলেন ও সেটাই।সেবার ডেভিড বেকহাম পাড়ি জমিয়েছিলো রিয়াল মাদ্রিদে।ওল্ডট্রাফোর্ডের ঐতিহ্যবাহী ৭ নাম্বার জার্সি ফাকা পড়েছিল। যে জার্সি পরেছে জর্জ বেস্ট আর বেকহামদের মতো লিজেন্ডরা , সেখানে অ্যালেক্স ফার্গুসন তুলে দিল এক আনকোরা তরুনের কাধে।

রোনালদোর ম্যানইউ যাত্রাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।২০০৩-০৭ আর ০৭-০৯।২০০৩ সালে রোনালদো  ছিলেন ইয়াং ট্যালেন্ট যে কিনা অকালেই ঝরে যেতে পারে অন্য অনেক ট্যালেন্টেড  খেলোয়াড় এর মতো আর ২০০৯ সালে রোনালদো এক পরিপক্ব খেলোয়াড় যে হতে পারে ফুটবল নামের এই খেলার ইতিহাসেরই সেরা।

২০০৩-০৭

বোল্টন ওয়ান্ডার্সের বিরুদ্ধে ২০০৩ সালের আগষ্টের ১৬ তারিখে অভিষেক হয় রোনাল্ডোর।৬০ মিনিটের মাথায় নিকি বাট এর পরিবর্তে  মাঠে নামেন ১৮ বছর বয়সী সন্তোস।খেলা শেষে দর্শকদের প্রশংসার জোয়ারে ভাসেন তিনি। সেবছর পহেলা নভেম্বরে ম্যান ইউয়ের হয়ে পোর্থমাউথের বিরুদ্ধে  ফ্রি-কিকে গোল করে প্রিমিয়ারলীগে প্রথম গোল করেন।২০০৩-০৪ মৌসুমে ম্যানইউ এর হয়ে প্রথম  এফএ কাপ শিরোপা জিতে।২০০৪-০৫ সিজনে ম্যান ইউ এফ কাপের ট্রাইবেকারে হেরে যায়।

২০০৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রোনালদোর বাবা মারা যান অতিরিক্ত মদ্যপান এর কারনে।সে কারনে নিজে কখনো  মদ্যপান করেন না।২০০৫-০৬ মৌসুমে বিভিন্ন বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে রোনালদো ।ইউসিএলের ম্যাচে বেনফিকার দর্শকদের "One Finger Gesture" দেখিয়ে এক ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা  কিংবা ম্যানচেস্টার ডার্বিতে অ্যান্ডি সোলেকে  লাথি মেরে বা  নিজের দলের রুব ভনের সাথে ঝামেলায় বারবার বিতর্কে জড়িয়েছেন।২০০৬ বিশ্বকাপে ঝামেলায় জড়িয়েছেন ওয়েন রুনির সাথে।যেকারনে পুরো ০৬-০৭ মৌসুমে শুনেছেন দর্শকদের দুয়োধ্বনি ।যদিও সেবার প্রিমিয়ারলীগ জিততে রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকা।

২০০৭-০৯

২০০৭-০৮ মৌসুমে রোনালদো  নিজেকে নিয়ে গেছেন সর্বোচ্চ শিখরে। প্রিমিয়ারলীগে করলেন ৩১ আর সব প্রতিযোগিতা মিলে ৪২ গোল।সেবার জিতেছেন সবকিছুই।দলীয়ভাবে জিতেছেন প্রিমিয়ারলীগ,শেফিল্ডশীল্ড আর চ্যাম্পিয়নস লীগের শিরোপা।নিজে জিতেছেন প্রিমিয়ারলীগ বেস্টপ্লেয়ার ,ইয়ং প্লেয়ার,গোল্ডেন সু , ব্যালন ডি'অর আর ইউরোপিয়ান গোল্ডেন সু।

২০০৮-০৯ মৌসুমে প্রিমিয়ারলীগে আবারো রোনালদো ভেল্কি চলে।ম্যানইউ জিতে নেয় টানা তৃতীয় প্রিমিয়ারলীগ ।চ্যাম্পিয়নস লীগে ও টানা দ্বিতীয় বারের মতো ফাইনালে ওঠে ম্যানইউ।কিন্তু সেবার লিও মেসির বার্সার কাছে ২-০ গোলে পরাজিত হয়।সে মৌসুমের মধ্য দিয়ে রোনালদোর ম্যানইউ অধ্যায় শেষ হয়।

ডস সন্তোস থেকে রোনালদো; এক মহা কাব্যিক আখ্যান


রিয়াল মাদ্রিদ (২০০৯-১৮)

সেসময় ট্রান্সফার মার্কেটের সকল রেকর্ড ভেঙে ৮০ মিলিয়ন ইউরোতে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেয় ।রোনালদোর রিয়াল মাদ্রিদ যাত্রাকেও দুই ভাগে ভাগ করা যায়।২০০৯-১২ আর ২০১৩-১৮ এ দুই ভাগে ভাগ করা যায়।

২০০৯-১২

৮০ হাজার দর্শকের সামনে  তাকে প্রদর্শন করা হয় বার্নাবুতে ২০০৯ সালের  ৬ জুলাই  ৯ নম্বর জার্সি গায়ে।পরে রাউলের বিদায়ী ম্যাচে রোনালদোকে জার্সি নাম্বার ৭ দেওয়া হয়।ডেপার্তিভো লা করুনার বিপক্ষে  তার রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ২৯ আগষ্ট ২০০৯ অভিষেক হয়।সে ম্যাচে পেনাল্টি থেকে গোল করে মাদ্রিদের হয়ে প্রথম গোল করেন।

ফুটবল যারা দেখে থাকেন , তাদের অধিকাংশ লোক ই ধরে নিয়েছিল রোনালদো হয়তো মেসির ছায়ায় হারিয়ে যাওয়া এক নক্ষত্র  হয়ে থাকবে।এসময়ে ১০-১১  তে গোল্ডেন সু আর  ১১-১২ এর লা-লীগা ছাড়া জেতেনি আর কিছুই।অন্যদিকে তার সবথেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী মেসির টানা চার ব্যালনডি'অর জয়।


২০১৩-১৮

পৃথিবীতে যারা মহারথী হয়েছেন,ভুল প্রমান করেছেন সবাইকে।সবকিছু সাজিয়েছেন নিজের মতো করে।ইতিহাস লিখেছেন নিজের নামে।১৩-১৪ মৌসুমে  জিতেছেন মাদ্রিদের হয়ে প্রথম চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। ১২ বছরের খরা কাটিয়েছেন মাদ্রিদের ।জিতেছেন আর ও  তিনটা।তাও আবার টানা তিন মৌসুমে ২০১৫-১৬, ১৬-১৭, ১৭-১৮ ।লা-লীগা জিতেছেন ২০১৬ তে,মাঝখানে দুটো কোপা দেলরে জিতেছেন।ক্লাব ওয়াল্ডকাপ আর সুপারকোপা ও জিতিয়েছেন। মাদ্রিদের হয়ে করেছেন ৪৩৮ ম্যাচে করেছেন ৪৫০ গোল।নিজে জিতিছেন ১৩ ,১৪ ,১৬,১৭ তে ব্যালন ডি'অর ।ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শু জিতেছেন ১৩ আর ১৪ তে আরো দুইবার।তিনবার জিতেছেন ইউইএফএ এর বেস্ট প্লেয়ারের পুরষ্কার ও। লিও মেসির সাথে ব্যালন ডি'অর এর দৌড়ে ৪-১ পিছিয়ে থেকে করেছেন ৫-৫। রিয়াল ভক্ত দের মন জয় করে অশ্রুশিক্ত করে ২০১৮ তে পাড়ি জমান ইতালির ওল্ড লেডিদের দলে।

জুভেন্টাস  (২০১৮- বর্তমান)

নানা বিতর্কের পর সব খোলসা খুলে পাড়ি জমালেন ২০১৮ তে ১০০ মিলিয়ন ইউরো তে মাদ্রিদ থেকে  জুভেন্তাসে ।জুভেন্তাসের হয়ে প্রথম মৌসুমে  জিতলেন  সিরিয়া আর সুপারকোপা ইটালিয়া।২০১৮-১৯ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি থেকে ফিরে গেলেন কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে।

সেকেন্ড রাউন্ডের ম্যাচটা অনেকের চোখে ভেসে থাকবে আরো বহু বছর।প্রথম  লেগে ২-০  তে পিছিয়ে পড়ে দ্বিতীয় লেগে ঘরের মাঠে হ্যাটট্রীক করে  অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের ডিফেন্স ভেঙে ৩-০ এর জয় দর্শক মনে রাখবে বহু বছর।

পর্তুগালের হয়েও অপ্রতিরোধ্য রোনালদো।দলকে জিতিয়েছেন ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ ২০১৬ আর নেশান্স লীগ ২০১৮।দলের হয়ে ১৬৪ ম্যাচে করেছেন ৯৯ গোল।
এইতো গত ওয়াল্ডকাপে ৮৭ মিনিটের মাথায় করলেন ফ্রি-কিকে দূর্দান্ত এক গোল।অথচ তার আগে করতে পারেননি টানা ৩৪ ফ্রি-কিকে গোল।কিন্তু দলের প্রয়োজনে বড় খেলোয়াড় সবার আগে এগিয় আসেন।তিনিও আসলেন আর ধারাভাষ্যকারকে বলতে বাধ্য করলেন "জিনিয়াস এবসুলেট জিনিয়াস"।

তারপরেও বিভিন্ন সময়ে কারনে অকারনে সমোলোচিত হয়েছেন।অনেকেই রোনালদোর তরুন বয়সের ড্রিবল,লং রেন্জ গোল আর ধারাভাষ্যকারের বলা "ইট্স ইমপসিবল ফর রোনালদো " বলা ফ্রি-কিক গুলোতে গোল ভুলে গেছেন।৩৩ বছর বয়সীর করা বাইসাইকেল কিক ভুলে গেছে সবাই!ভুলে গেছে২.৫৬ উচ্চতার হেডার !এসবের সৌন্দর্য খোঁজে না কেউ!দুই ম্যাচ খারাপ খেললেই সমোলোচকরা বলে ওঠে তুমি শেষ!কিন্তু না , তিনি ফিরবেন !খাদের কিনারা থেকে ফিরতে তিনি পছন্দ করেন।তাইতো তিনি বলে থাকেন ,"Your love makes me stronger, Your hate makes me Unstoppable."