দক্ষিণবঙ্গে খান জাহান আলী একটি অতি পরিচিত নাম। শত শত বছর পেরিয়ে গেলেও সেই নাম এখনো বিন্দুমাত্র ম্লান হয়নি। একাধারে খান জাহান আলী ছিলেন একজন তিনি ছিলেন একজন সূফি, ইসলাম প্রচারক, স্থপতি,
যোদ্ধা, শাসক ও সাধক। ইসলাম ধর্মের প্রচারক হিসেবেই তিনি সমাধিক খ্যাত।
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে যেসকল ওলী-আউলিয়াদের উল্লেখ আছে তাঁদের মধ্যে পরিচিত একটি নাম হযরত খান জাহান
আলী (র)। তার জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি ব্যয় করেন ইসলামের সেবায়। তৎকালীন সময়ে চারিদিকে ইসলাম ও মুসলিমদের
দুরবস্থা দেখে তিনি বিচলিত হয়েছিলেন। তাই সমাজ সেবা, ইসলাম রক্ষা ও ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে
নিয়োজিত করেছিলেন নিজেকে।
ষাট গম্বুজ মসজিদ ছবিঃ উইকিমিডিয়া |
খান জাহান আলীর প্রকৃত জন্ম তারিখ
সম্পর্কে কোন সঠিক তথ্য নেই। ১৩৬৯
খ্রিষ্টাব্দে দিল্লিতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে পিতা আকবর খাঁ এবং মাতা আম্বিয়া
বিবির কোল আলোকিত করে পৃথিবীতে আসেন তিনি। প্রাথমিক শিক্ষা জীবন পিতার হাত ধরে শুরু হলেও তিনি
মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন দিল্লির বিখ্যাত
ওয়ালি এ কামিল পির শাহ নেয়ামত উল্লাহর কাছে। তিনি কুরআন, হাদিস, সুন্নাহ ও ফিকহ
শাস্ত্রে অত্যাধিক পারদর্শীতা অর্জন করেন, যা তাকে পরবর্তী জীবনে
ইসলামের প্রতি অগ্রসর করেছিল। খান জাহান আলীর বাল্য নাম ছিল খান। অল্প বয়সেই তিনি
পিতা আকবর খাঁ কে হারান।
আম্বিয়া বিবি বহু কষ্টে তার লালন
পালন করতে থাকেন। খান জাহান আলী ছিলেন খুব প্রতিভাবান আর বুদ্ধিমত্তার অধিকারী যার
ফলে একদিন বাদশাহ হোসেন শাহের সুদৃষ্টিতে পড়েন
তিনি। এখানেই প্রতিপালিত হতে থাকেন তিনি ।
কিন্তু সুখ বেশি দিন সইলো না। বাদশাহর
মৃত্যুর পর দরবারের লোকেরা তার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার শুরু করলো এমনকি তার মায়ের
জন্য নির্ধারিত শাহী বেতন-ভাতাও বন্ধ করে দিল। অসহায় খান জাহান তার ওস্তাদ নূর
কুতুবুল আলমের সরোনাপন্ন হন । ওস্তাদ তাকে সুলতান ইব্রাহীম শর্কির কাছে যেতে বলেন।
সাথে একটি চিঠিতে তিনি খান জাহানের সচ্চরিত্র ও প্রতিভার কথা অবগত করেন সুলতানকে।
সুলতান খান জাহানকে সৈনিকের চাকরি প্রদান করেন। সৌভাগ্যের সূচনা হয়। প্রতিভা আর একনিষ্ঠতার বলে খুব কম সময়ে একজন
সাধারণ সৈনিক থেকে প্রধান সেনাপতির পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন খান জাহান আলী। সেনাপতি
থাকা অবস্থায় তার নতৃত্বে গৌড়ের রাজা গনেশকে পরাজিত করেন। গনেশ ইসলাম ও মুসলিমদের উপর অনেক অত্যাচার
চালাতেন তাই ইসলাম ও মুসলিমদের রক্ষা করার জন্য রাজা গণেশকে দমন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া
হয়। এরপর খান জাহান আলী গৌড় ছেড়ে চলে আসেন। এসময়ে নূর কুতুবুল আলম এর কন্যার সাথে খান
জাহান আলী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
খান জাহান আলী সেতু ছবিঃ উইকিমিডিয়া |
চারিদিকে ইসলাম ও মুসলিমদের অত্যাচারিত অবস্থা দেখে খান জাহানের মন কেদে উঠলো। বেরিয়ে পড়লেন দক্ষিনবঙ্গের উদ্দেশ্য তখন গৌড়ের সুলতান ছিলেন জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ শাহ। ১১ জন আউলিয়া নিয়ে তিনি প্রথমে যশোরের বারোবাজারে উপস্থিত হন এবং সেখানে ইসলামের প্রচার করেন। পরবর্তীতে মুরলী কসবা ইত্যাদি শহরে ইসলামের প্রচারনা চালান। এসময়ে তিনি এক নতুন শহরে পত্তন করেন তিনি যার নাম খলিফাতাবাদ, বর্তমান নাম বাগেরহাট শহর। তিনি প্রতিটি এলাকায় ইসলাম প্রচার করতে শুরু করেন এবং একজন করে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। খান জাহান আলী যখন দক্ষিণবঙ্গে আসেন তখন বেশিরভাগ জায়গাই ছিল বনাঞ্চল। সেই বন-জঙ্গল পঅরিষ্কার করে তিনি ও তার অনুসারীরা এ অঞ্চলকে বসবাসের উপযোগী করে তোলেন। ৪০ বছর দক্ষিণবঙ্গে রাজত্ব করেন খান জাহান আলী তখন তার রাজ্যে তিনি কায়েম করেন ইসলামী হুকুমত। পুরো এলাকায় তিনি ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেন । তাঁর বিনয়ী আচরন ও সুশাসনে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।
খান জাহান আলীর মাজার ছবিঃ উইকিমিডিয়া |
খানজাহান তার দুই দুই স্ত্রীর নাম
অনুসারে সোনা মসজিদ এবং বিবি বেগনি মসজিদ নামে মসজিদ নির্মাণ করেন। এছাড়াও দক্ষিনবঙ্গে
তার নির্মিত ষাট গম্বুজ মসজিদ অত্যন্ত বিখ্যাত। হযরত খানজাহান আলি (র.) অক্টোবর
২৫, ১৪৫৯ তারিখে ষাট গম্বুজ মসজিদের দরবার গৃহে এশার নামাজ রত অবস্থায় ৯০ বছর
বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
0 Comments
Post a Comment