একটি বিখ্যাত ও জনপ্রিয় উক্তি আছে, “ যদি তুমি মানুষকে বিচার করতে যাও তাহলে ভালবাসার সময়
পাবে না ” যার সাথে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত।
কার কথা মনে পড়ছে? --- হ্যা, মাদার তেরেসার কথা বলছি। যিনি মানুষকে ভালোবেসেছেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে। তিনি আজীবন মানব সেবায় নিয়োজিত করেছেন নিজেকে, যা আমাদের অনুপ্রানিত করে সারাজীবন
মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। মাদার তেরেসার
মতন মহিয়সীরা বার বার জন্মান না। তবে মৃত্যুর পরেও মানুষ তাদের মনে রাখে তাদের
কাজের জন্য। করোনা প্রাদুর্ভাবে সমগ্র
বিশ্বের এই ক্রান্তিকালে মাদারের মত কিছু লোকের দেখা পেলে মন্দ হতো না৷
জন্ম ও ছেলে বেলা
২৬শে আগস্ট
১৯১০ সাল, মেসিডোনিয়ার বর্তমান ‘স্কাপা’ নামক স্থানে বাবা নিকোলো বোজেক্সাক এবং মা ড্রানাফিল বোজেক্সের ঘরে জন্মগ্রহন
করেন মাদার তেরেস । বংশগত ভাবে তিনি আলবেনীয় হলেও
তিনি ছিলেন ভারতীয় ক্যাথেলিক সন্নাসী। নিকোলো বোজেক্স আলবেনিয়ার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মাদার
তেরেসা তিন সন্তানের মধ্যে ছোট হওয়ায় বাবা
- মায়ের আদর ও পেতেন বেশি। ভালোবেসে
তাই মাদারের নাম রাখা হয়েছিলো অ্যাগনেস গঞ্জা বয়াজু।
কিন্তু সেই ভালোবাসা বেশি দিন স্থায়ী
হয়নি। মাত্র ৮ বছর বয়সে, ১৯১৮ সালে বাবা নিকোলো বোজেক্স মারা যান। নিকোলোর মৃত্যুতে অসহায় হয়ে পরেন ড্রানফিল,
দুঃখ-কষ্ট আর বিভিন্ন প্রতিকূলতা নেমে আসে পুরো পরিবারের ওপর। মা ড্রানাফিল বোজেক্সা অসম্ভব কষ্ট করেছেন তার
সন্তানদের লালন-পালন করার জন্য।
গৃহত্যাগ ও সন্নাস গ্রহন
অ্যাগনেস গঞ্জা বয়াজুর জীবনও ছিলো প্রবাহমান নদীর মত আঁকা-বাঁকা। মাত্র ১২ বছর বয়সেই তিনি ধর্মীয়ভাবে সন্নাসীনী হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন
করেন। মা ড্রানফিলও বাধা দেননি তার এই
সিদ্ধান্তে। ১৯২৮ সালে, আঠারো বছর বয়সে তিনি গৃহ ত্যাগ
করেন।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এরপর থেকে মৃত্যুর
আগ পর্যন্ত তার মা অথবা বোনের সাথে আর কখনোই
দেখা হয়নি। গৃহ ত্যাগের পরে তিনি সিস্টার্স
অব লেরোটা নামের একটি সংস্থায় মিশনারী হিসেবে যোগ দেন। এখানে দিন বেশ ভালোই কাটছিলো তেরেসার।
১৯৩১ সালে সন্নাসীনী হয়ে শপথ গ্রহনের পর থেকেই
তার নাম তেরেসা রাখা হয়।
তেরেসার অবদান
মাদার তেরেসার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য
ছিলো মানবসেবা। সন্নাসীনী তেরেসার মানবসেবাকে একমাত্র পেশা হেসেবে
গ্রহন করেন। দরীদ্র ও অনাহারীদের জন্য সবসময় তার মন কাঁদত। আসহায়দের
খাবারের বন্দোবস্ত্য করতে এবং আবাসনহীন
মানুষের থাকার জায়গা দেওয়ার জন্য তিনি
মানুষের দরজায় দরজায় ঘুরতেন। ধনী ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে অসহায়দের জন্য ব্যয় করতেন ।
মাদার তেরেসা কুষ্ঠরোগীদের জন্য
ভারতের চিটাগড়ে প্রেমনিবাস নামক আবাসন প্রতিষ্ঠা করেন। কুষ্ঠরোগ ছোঁয়াচে মনে করে সমাজ কুষ্ঠ রোগীদের
আলাদা চোখে দেখতো। দূর্গন্ধ যুক্ত ঘা
হওয়ার কারনে এই রোগীদের পাশে কেউ যেত না।
কিন্তু মাদার তেরেসা নিজেই তাদের সেই ঘা ধুইয়ে দিতেন৷
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী
শিবিরে মাদার তেরেসা বহুমুখী সেবা প্রদান করেছিলেন । পুরান ঢাকার ইসলামপুরের ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’ এর সাথে ওতপ্রোতভাবে
জড়িয়ে আছে মাদার তেরেসার অবদান। যুদ্ধ
বিদ্ধস্ত দেশে অসহায় শিশু ও নির্যাতিত নারীদের নিয়ে অনেক কাজ করেন তিনি। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল
যুদ্ধশিশুদের বাইরের দেশে দত্মক দেওয়া।
পুরষ্কার ও সম্মাননা
১৯৭৯ সালে মাদার তেরেসা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন বিভিন্ন মানবিক কাজের সাথে যুক্ত থাকার জন্য। অসুস্থ ও মুমূর্ষদের চিকিৎসা, বাস্তুহীনদের
আবাসন প্রদান এবং এতিম শিশুদের লালন পালনের মত
মহান কাজ করতেন তিনি । ১৯৮০ সনে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মানীয় পুরস্কার ‘ভারতরত্ন’ অর্জন করেন মাদার তেরেসা। এছাড়াও ১৯৮৫ সালে প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল
অব ফ্রিডম এবং ১৯৭৮ সনে বালজান পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।
জীবনাবসান
১৯৮৩ রোম যাবার পথে মাদার তেরেসা প্রথম বারের মত হার্ট এ্যাটাক
করেন। ছয় বছর পর আবার তিনি দ্বিতীয়বারের
মত হার্ট এ্যাটাকের শিকার হোন। তারও দুই বছর পর ১৯৯১ সালে মেক্সিকোতে থাকার সময় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। এরপর ১৯৯৬ সালে তিনি
ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। এতে তেরেসার হৃৎপিন্ড বিশেষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ১৯৯৭ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর মাদার তেরেসা মৃত্যু বরন করেন।
মাদার তেরেসার কথা ভাবতেই মনে পরে
সেই নীল পাড় সাদা রঙের শাড়ি।
মাদার তেরেসা কখনোই জাত-ধর্ম-বর্ণের বিচার
করেননি, সবাইকে ভালোবেসেছেন মানুষ হিসেবে।
তিনি আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন যে প্রকৃত ঈশ্বরপ্রীতি রয়েছে সকল মানুষের প্রতি
ভালোবাসায়।
আরও পড়ুন- রহস্যময়ী ক্লিওপেট্রার মৃত্যু রহস্য
0 Comments
Post a Comment