যদি হঠাৎ মানব জাতীর বিলুপ্তি হয়! আমাদের বাসস্থান,  আমাদের বানানো সব জিনিসগুলো যদি অন্য প্রজাতির কাছে খুব আশ্চর্যের হয়! বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে যদি আমাদের চিত্রকর্ম স্থান পায়!  তাহলে কেমন হবে?  খুব বেশি অস্বাভাবিক বা খারাপ কিছু হবে না।  কারন আজ যেটা নতুন কাল সেটা পুরাতন। এমনই এক দ্বীপের বাসিন্দাদের হাতে বানানো কিছু মুর্তি এখন বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে একটি।  এমনকি ওই বাসিন্দাদের স্থাপত্য কীর্তিকে ১৯৯৫ সালে ‘ওয়র্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর মর্যাদাও দিয়েছে ইউনেস্কো। এইজন্যই হয়তো বলে 'ওল্ড ইজ গোল্ড ' যাইহোক বলছি ইস্টার আইল্যান্ডের কথা।    
দক্ষিণ-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে চিলের একটি দ্বীপ এই ‘ইস্টার আইল্যান্ড’। 
ইস্টার আইল্যান্ডের  দানবাকৃতির মোয়াই রহস্য
মোয়াই, ইস্টার আইল্যান্ড
ছবিঃ উইকিমিডিয়া   
স্থানীয়দের কাছে এই ইস্টার আইল্যান্ড ‘রাপা নুই’ নামে পরিচিত।  এই রাপা নুই প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণে ৬৪ বর্গমাইল জুড়ে বিস্তৃত একটি অভূতপূর্ব রহস্যে ঘেরা দ্বীপ। আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টাব্দে পলিনেশিয়ানদের পা পড়েছিল ওই দ্বীপে। এই দ্বীপটি এতোটাই গহীনে যার অস্তিত্ব খুজে পাওয়া খুব কঠিন ছিল।  সবচেয়ে কাছের বাসযোগ্য দ্বীপ পিটকেয়ার্ন আইল্যান্ড থেকে ইস্টার আইল্যান্ডের দূরত্ব ২০৭৫ কিলোমিটার। আর শহর অর্থাৎ যেখানে মানুষের  বসবাস, সেটাও প্রায় ২৬০৬ কিলোমিটার দূরের মাঙ্গারেভা আইল্যান্ড। ইস্টার আইল্যান্ডের এতো রহস্য এটিকে নিয়ে এতো আলোচনার কারন হলো এখানকার মোয়াই বা মূর্তি।  বহু শতাব্দী আগে আগ্নেয়-দ্বীপের বাসিন্দারা পাথর খোদাই করে এই  প্রকাণ্ড মোয়াইগুলো এবং কিছু মুখ (জায়ান্ট হেডস) বানিয়েছিলেন। কথিত আছে এগুলো  পূর্বপুরুষ পলিনেশিয়ানদের মুখ।  ইস্টার দ্বীপের এই মোয়াই মূর্তিগুলো সকল পর্যটকদের ভাবতে বাধ্য কের তাদের অস্তিত্বের কথা তাদের নির্মাণশৈলীর কথা। একটা-দু’টো নয়। অন্তত হাজারটা মূর্তি বা ‘মোয়াই’ রয়েছে ত্রিভুজাকৃতির এই দ্বীপে।  কিন্তু সবথেকে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো কেউই জানে না কিভাবে এই দ্বীপে প্রায় ২০ টন ওজনের  মূর্তিগুলো আনা হল। 

ইস্টার আইল্যান্ড: দানবাকৃতির মোয়াই রহস্য
ইস্টার আইল্যান্ড
ছবিঃ উইকিমিডিয়া   

"ইস্টার আইল্যান্ড" দ্বীপের সন্ধান: 

সেদিন ছিল 'ইস্টার সানডে', ১৭২২ সালের  ৫ এপ্রিলের কথা। ডাচ নৌ সেনাপতি জ্যাকব রজারভিন আবিষ্কার করেন জনবিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ। জ্যাকব রগেবেনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো “Terra Australias” খুঁজে বের করার যাতে “Spice Island” এ বাণিজ্য পথের রাস্তা খোলা যায়। সফরপথে জুয়ান ফারনান্দেজ দ্বীপে অবস্থান শেষে তারা পৌছে এই নতুন দ্বীপে। যেহেতু সেদিন ছিলো ইস্টার সানডে তাই দ্বীপটির নামকরণ করা হয় “ইস্টার আইল্যান্ড”। কথিত আছে জ্যাকব এই দ্বীপে ভুল করে চলে এসেছিলেন, তিনি মূলত খুঁজছিলেন ভিন্ন এক দ্বীপ, ডেভিস আইল্যান্ড কিংবা ডেভিডস আইল্যান্ড। এই দ্বীপে শুরুর সময়টাতে  জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৫,০০০।  ১৮৬২ সালে পেরুভীয় দাস ব্যবসায়ীরা আক্রমণ করে ১৫০০ মানুষকে ধরে নিয়ে যায় এই দ্বীপ থেকে। তারপর জলবসন্ত, ধনুষ্টংকার ইত্যাদি রোগে অনেক অধিবাসী মারা যান। এক পর্যায়ে যখন ডাচ ভ্রমণকারীরা এখানে এলেন তখন জনসংখ্যা ছিল মোটে দুই কি তিন হাজার। আর ১৮৭৭ সালের দিকে এ দ্বীপের মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ১১১ জন।  জ্যাকব এখানে এসেই তার ক্রুদের দিয়ে এখানে আগুন ধরিয়ে দেন, যাতে মারা যায় ১২ জন অধিবাসী।  
এ দ্বীপের আদিবাসীরা সম্ভবত ৭০০ থেকে ১১০০ সালের মাঝে এখানে এক সুন্দর সমাজ গড়ে তুলেছিল। তাই বলা চলে ইস্টার আইল্যান্ডের রহস্য আজকের নয়। এই দ্বীপের রহস্য ঘেরা মোয়াইগুলো মাটিতে অবস্থান করছে খুব আশ্চর্য রকমভাবে। মূর্তিগুলোর মাথার অবস্থান মাটির উপরে এবং বাকি অংশটুকু মাটির নিচে। এখানে একটি অসম্পূর্ণ মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল যার উচ্চতা ছিলো প্রায় ৬৯ ফুট এবং ওজন ২৭০ টন। বিভিন্ন গবেষনা এবং বিচার বিশ্লেষণের পর এর গঠনশৈলী বিবেচনায় জানা যায় প্রতিটি মূর্তি সংকুচিত আস্ত আগ্নেয় শিলা হতে খোদাই করা হয়েছে। 

ইস্টার আইল্যান্ড: দানবাকৃতির মোয়াই রহস্য
ইস্টার আইল্যান্ডের আগ্নেয়গিরি
ছবিঃ flickr 

ইস্টার আইল্যান্ডে রয়েছে তিনটি মৃত আগ্নেয়গিরি। ইস্টার দ্বীপের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল- সাতটি বৃহদাকার ভাস্কর্য। যাদের একসাথে ‘নেভল অব দ্য ওয়ার্ল্ড‘ বলা হয়। অর্থাৎ পৃথিবীর নাভি বলা হয় তাদের। দ্বীপটিতে সব মিলিয়ে প্রায় হাজারখানেক ভাস্কর্য রয়েছে যদিও বর্তমানে ৪০০'র বেশি আর দেখা যায় না। এ ছাড়াও আছে পাথরে তৈরি ৮০০টি মূর্তির মাথা। এর মধ্যে বেশ কিছু মূর্তি দেখা যাদের মাথায় থাকে হ্যাট বা টুপি আকৃতির কিছু যাকে বলা হয় “পুকাও”। যা পোলেনেসিয়ার চীফদের পরিহিত লাল পালকের আবরণের স্মৃতিচিহ্ন প্রকাশ করে। অনেকেই এটাকে শক্তির বহিঃপ্রকাশ বলে অভিহিত করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় মাথাটির উচ্চতা ৩২ ফুট এবং ওজন ৯০টন। এই দ্বীপে “El Gigante” নামক মোয়াই মূর্তির যে নাম পাওয়া গেছে,  যদি এই মূর্তিটির কাজ সম্পূর্ণ করা হতো তবে এটিই হতো সবচেয়ে বৃহৎ আকারের মোয়াই মূর্তি যার উচ্চতা হতো ২১ মিটার এবং ওজন প্রায় ১৮০ টন। ইস্টার দ্বীপে আছে ‘আহু‘ বলে পরিচিত পাথরের কিছু বিশাল বিশাল প্ল্যাটফর্ম। আছে পাথরের তৈরি বিস্ময়কর দেয়াল, পাথরের ঘর ও গুহাচিত্র। যা সৌন্দর্যের সাথে সাথে বিস্ময়কে যেন আরও বাড়িয়ে দেয়।

ইস্টার আইল্যান্ড এই দানবাকৃতির মোয়াইগুলো কেন নির্মান করা হয়েছিল?    

ইস্টার আইল্যান্ডে এই দানবীয় মূর্তিগুলো নির্মাণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। তখনকার যুগে কুষ্ঠ রোগ হতে বাঁচতে এই দ্বীপের অধিবাসীরা এসব মূর্তি বানাত। “বিদঘুটে আকৃতির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এর বিপরীতে সংশোধিত এই মূর্তিগুলো বানানোর মাধ্যমে দেশ হতে রোগের প্রাদুর্ভাব এড়ানো সম্ভব। এরমধ্যে লক্ষণীয় হলো কুষ্ঠব্যাধির ফলে নাকের তরুণাস্থি ভেঙ্গে যায় এবং দ্বীপবাসীরা মোয়াই মূর্তিতে সেসব কিছুর সংশোধন করে নাকের একটা ভালো আকৃতি দান করে।”

ইস্টার আইল্যান্ড: দানবাকৃতির মোয়াই রহস্য
মোয়াই মুর্তি
ছবিঃ উইকিমিডিয়া  

এই মূর্তিগুলো নিয়ে  অনেকের মনেই প্রশ্ন আছে কেনো মূর্তিগুলো দেশের অভ্যন্তরে মুখ করে বানানো হয়েছে - এ সম্পর্কে গবেষকরা বলছেন, তখনকার অধিবাসীরা মনে করতো তারা বাদে এই পুরো জগতে আর কোন মানুষ নেই যার কারণে আক্রমণকারীরা সমুদ্র পথে আসবে না বরং তারা হবে ভেতরে অবস্থানরতদের মধ্যেই কেউ যার কারণে মূর্তিগুলোকে ভেতরে মুখ দিয়ে রাখা হয়েছিলো দ্বীপ রক্ষার জন্যে।
দ্বীপে যে মূর্তিগুলো দেখা যায় তার মধ্যে  কিছু মূর্তি শোয়ানো অবস্থায় দেখা  যায় এবং এ সম্বন্ধে কিছু কুসংস্কার আছে যা হলো এসব মূর্তি শুইয়ে রাখার পিছে কিছু কারণ আছে তাই এসব মূর্তি দাঁড় করানো চেষ্টা না করাই উত্তম, দাঁড় করালে অভিশাপ লাগতে পারে। তাই এই ভাবনা থেকেই আজ পর্যন্ত এই মূর্তিগুলো শোয়ানোই আছে। 
মোয়াই এবং ভাস্কর্যগুলোর সঙ্গে প্রতিদিন মিষ্টি পানি পাওয়ার সম্পর্কের বিষয়টি এখানকার অধিবাসীদের কাছে বেশ জটিল বিষয়। এই মোয়াই এবং ভাস্কর্যগুলোতে কিছু দৈবশক্তি বিদ্যমান বলে পূর্বপুরুষদের যে বিশ্বাস ছিল তা বংশপরম্পরায় এখনো এখানকার অধিবাসীদের  ভেতর প্রতিফলিত। 
পৃথিবীতে এমন অনেক রহস্যময় জায়গা রয়েছে যেগুলোতে হয়তো এখনও কারও পা পড়েনি বা যেসব জায়গার মাহাত্ম্য আজও সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়নি। ইস্টার আইল্যান্ড এমনই একটি জায়গা যা প্রমাণ করে হাজার বছর আগে সেই জায়গাটি ছিল বিজ্ঞান ও বুদ্ধিতে সমৃদ্ধ। এখানকার একটি বিশেষ সৌন্দর্য হচ্ছে মোয়াইদের এমন ভাবে সাজানো হয়েছে যাতে ২২ সেপ্টেম্বর ও ২০ মার্চ এই দুইদিন আড়াআড়ি করে মোয়াইদের ওপর সূর্যের আলো পড়ে।  



তথ্যসূত্র:
*Easter Island at DMOZ.
*Mystery of Easter Island – PBS Nova program.