জাতীয় বাজেট রাষ্ট্রের আয়-ব্যয় প্রাক্কলনের পরিকল্পিত দলিল। কিন্তু আমাদের মতো দেশের জন্য বাজেট আয়-ব্যয়ের প্রাক্কলনের বাইরে দেশের সামগ্রিক আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে, সাথে একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং অর্থনীতির একটা শক্তিশালী ভিত তৈরিতে কাজ করে। সে হিসেবে আমাদের দেশের বাজেট সমন্বয় বিশাল চ্যালেঞ্জের ব্যাপার বটে!

তরুণদের বাজেট ভাবনা (পর্ব-১)



স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ৩০ জুন, ১৯৭১-৭২, ১৯৭২-৭৩ সেশনের বাজেট পেশ করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। তখনকার সময় বাজেটের আকার ছিলো ৭'শ ৮৬ কোটি টাকা। তারপর থেকে সময়ের প্রয়োজনে বাজেটের পরিধি বেড়েই চলছে! সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের ২০০৩ সালে পেশকৃত ৩১ তম বাজেটে প্রথমবারের মতো ৫০ হাজার কোটি টাকার মাইলফলক-অতিক্রম করে।(৫১ হাজার ৯'শ ৮০ কোটি টাকার বাজেট)। 


বিশ্বব্যাপি চলমান কোভিড-১৯ অর্থনীতির চলমান ধারাকে প্রায় বিপর্যস্ত করে রেখেছে। স্বাস্থ্যঝুঁকির সাথে বিশ্বব্যাপি বিশাল অর্থনৈতিক মন্দায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে। চলমান অর্থনৈতিক স্থবিরতায় বিশ্ব অর্থনীতিতে সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ দাড়াতে পারে ৫ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন থেকে ৮ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৯ লাখ কোটি মার্কিন ডলারে এমন পূর্বাভাস জানিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) অর্থনীতি নিয়ে প্রকাশিত "পটেনশিয়াল ইকোনোমিক ইমপ্যাক্ট অব কোভিড ১৯" শীর্ষক প্রতিবেদনে। এমনটাও জানিয়েছে, দক্ষিন এশিয়ার মোট দেশজ উৎপাদনে করোনাজনিত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৪ হাজার ২০০ কোটি থেকে ২১ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের মতো!
বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী মন্দা হয়েছিলো ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত, যাকে আমরা মহামন্দা বলে জানি। 


২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটটি গতানুগতিক চ্যালেঞ্জের থেকে একটু বেশি চ্যালেঞ্জ কেননা এবারের বাজেটে অর্থনীতিকে পূর্বের চাকায় ফিরিয়ে নেওয়ার সমন্বয়ের ব্যাপারটা-ও আছে। বাজেটের আর্থিক আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা যা বরাবরের মতোই পূর্বের বাজেটের আর্থিক রেখা অতিক্রম করেছে।

এবারের বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক নিয়ে আলোচনা করা যাকঃ

সামাজিক নিরাপত্তা খাতঃ

এবারের বাজেটে সামজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ ও উপকার ভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিগত বছরের তুলনায়  বরাদ্দ  ১ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৭৬ হাজার কোটি টাকা; যা অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ, যার মাধ্যমে প্রায় এক-চতুর্থাংশ পরিবারকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে। চলমান মহামারিতে বিশাল জনগোষ্ঠী দারিদ্র্য সীমার নিচে পড়ে গেছে এবং সামনের দিনগুলোতে আরো বড় সংখ্যক জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য সীমার নিচে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং(সানেম)', তাদের গবেষণায় পূর্বাভাস দিয়েছে, দেশে দারিদ্র্য হার "২০ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৪০ দশমিক ৯ শতাংশে পৌঁছাতে পারে"। 
তাই, সম্ভাব্য নতুন এই দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীকে-ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় যেনো আনা হয় সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।

আমাদের বাজেট ভাবনা


প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা কি অর্জন সম্ভব?  

এবারের বাজেটেও  প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৮.২ শতাংশ! যাতে প্রশ্ন থেকে যায় করোনাকালীন এই সময়ে অর্থনীতির সংকট মোকাবিলা করা হবে নাকি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে.? ২০১৮,২০১৯ সালে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ছিলো যথাক্রমে ৮% এবং ৭.৯%।  এই মন্দা অবস্থায় প্রবৃদ্ধি থেকে আমাদের প্রয়োজন অর্থনীতির একটা রিকোভারি। অন্যদিকে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক(এডিবি) পূর্বাভাস দিয়েছে চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৪.৫ শতাংশ!  

তাই এই সময়ে আমাদের প্রয়োজন প্রবৃদ্ধিকে পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা। অথাৎ, আমাদের দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বরোপ করতে হবে যাতে অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারে। যাকে অর্থনীতিতে ভি-শেপড রিকোভারি বলে।

তাছাড়া, এইসময়ে ব্যাক্তিগত খাতে বিনিয়োগ বিপুল হারে হ্রাস পাবে এবং রেমিট্যান্স অর্জনেও বড় ধরণের ধাক্কার একটা আশঙ্কা-তো আছেই। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে যেখানে ১৫ দিনেই  রেমিট্যান্স এসেছে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে, ফেব্রুয়ারি মাসে মোট রেমিট্যান্স ছিলো ১৪৫ কোটি মার্কিন ডলার, মার্চে ১৭ কোটি টাকা কমে দাড়িয়েছে ১২৮ কোটি মার্কিন ডলারে! এপ্রিলে কমে দাড়িয়েছে ১০৪ কোটি ১০ লাখ ডলারে! (তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশ ব্যাংক)

ঘাটতি বাজেট

এবারের বাজেটে রাজস্ব আয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। বাকী ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার একটা বিশাল ঘাটতি রয়েই যায়।

এই ঘাটতি পূরণের জন্য ৮০ হাজার ১৭ কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার একটা পরিকল্পনা করা হয়েছে। বাকী ১ লাখ ৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংস্থান করা হবে। এর মধ্যে বিশাল একটা অংশ ব্যাংকিং খাত থেকে সংগ্রহ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে(৮৪ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা)।  ব্যাংকিং খাত থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করলে বেসরকারি বিনিয়োগে খাত তথা ব্যাংকিং সেক্টরও হুমকির মুখে পড়বে। তাছাড়া, ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিনের একটা দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামো তো আছে সাথে অব্যবস্থাপনা আর ঋণখেলাপীর একটা অশুভ সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, দিন দিন খেলেপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। 

প্রত্যক্ষ কর ও পরোক্ষ করঃ

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ করের অবদান তুলনামূলক কম। এবারের বাজেটে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের অনুপাত ৩৫:৬৫। আমাদের দেশে পরোক্ষ কর থেকে প্রত্যক্ষ কর আদায়ে অধিকতর গুরুত্বারোপ করতে হবে।  একসময় বাংলাদেশে অতি-ধনীর বৃদ্বির হারে বিশ্বে প্রথম ছিলো এখন ধনী বৃদ্বিতে বিশ্বে তৃতীয়। তাই গিনি সহগের মাত্রা দ্রুতই বৃদ্বি পাচ্ছে।  এই অতিধনী এবং ধনী গোষ্ঠীর  আয়কর ও সম্পদের উপর কর নিশ্চিত করে প্রত্যক্ষ করের মাত্রা বাড়ানো যেতে পারে।

মোবাইল সিম কার্ড ব্যবহারে সম্পুরক শুল্ক বাড়ানো কতটুকু যুক্তিযুক্তঃ

মোবাইল ফোনে সিম ব্যবহারের মাধ্যমে সেবার বিপরীতে সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে ফোনে কথা বলা, এসএমএস দেওয়া বা ডেটা ব্যবহারের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর,১ শতাংশ সারচার্জ, আর ১৫ শতাংশ সম্পুরক শুল্ক এবং অনান্য কর মিলে মোট কর ৩৩.২৫ শতাংশে দাড়ালো। এক্ষেত্রে করোনাকালীন সময়ে গ্রাহকদের খরচ বেড়েই যাচ্ছে!
দৈহিক দুরুত্ব বজায় রাখলেও সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সরব তাছাড়া এখনকার সময়ে অনলাইনে কেনাকাটা যেমন বাড়ছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে ই-কমার্স সাইটও বাড়ছে।  এই সাইটগুলার পরিচালন খরচ বেড়ে যাবে ইন্টারনেটের খরচ বাড়ার সাথে সাথেই। এক্ষেত্রে ডেটা প্যাকে সম্পূরক শুল্ক আরোপ না করে শুধুমাত্র সিম ব্যবহার করে কথা বলায় শুল্ক আরোপ করা যেত।


আমাদের বাজেট ভাবনা

স্বাস্থ্য খাতে বাজেট কতটুকু বাড়লো? 

করোনাভাইরাস মহামারির এই সময় স্বাস্থ্য খাতের চরম অব্যবস্থাপনা ও ভঙ্গুর অবস্থা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সেই সাথে বেসরকারি খাতের চরম দায়বদ্ধতার অভাব-ও  লক্ষ্যনীয়। 
এই সময়ে স্বাস্বস্থ্যসেবা খাতকে ঢেলে সাজানোর একটা পরিকল্পনা দরকার সেই সাথে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্টান গুলোকে একটা নিয়ন্ত্রণ রেখার মধ্যে নিয়ে আসা প্রয়োজন।

এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি যা মোট বরাদ্দের ৭.২ শতাংশ। বিগত অর্থ বছরের তুলনায় তিন হাজার কোটি টাকা বেশি।
এবার শুধু করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা।
দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে দীর্ঘদিনের একটা ক্ষত তৈরি হয়েছে, তাছাড়া কোভিড -১৯ এবার একটা বড় ধরণের ধাক্কা দিয়েছে স্বাস্থ্য খাতকে। সে হিসেবে এবারের বাজেটে অন্তত সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া যেতো স্বাস্থ্য খাতে। সংস্কার, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা সেবার মান বাড়ানো, অবকাঠামোর মানোন্নয়ন, জনবল বাড়ানো এইসব বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন ছিলো। 

সর্বোপরি, বাজেট বাস্তবায়ন বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায় তাছাড়া বিভিন্ন খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যবহার না করে ফিরিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা আছে। বরাদ্দকৃত বাজেট যেনো কার্যকর উপায়ে ব্যবহার করা হয় বিশেষ নজর রাখতে হবে।



রেফারেন্সঃ
১. জাতীয় বাজেট ২০২০-২০২১
২. সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)
৩. "পটেশিয়াল ইকোনমিক ইমপ্যাক্ট অব কোভিড-১৯" এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক(এডিবি)
৪. বাংলাদেশ ব্যাংক 


লেখকঃ
মোহাম্মদ আকমল উদ্দিন 
শিক্ষার্থী 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়