ঘুমিয়ে পড়েছিলেন! হঠাৎ ঘুম ভাঙলো ভীষণ শব্দে। রুমি-জামি ছুটে এল মায়ের খোঁজে। বেশ কয়েক রকমের শব্দ শোনা গেলো। মেশিনগানের ঠাঠা শব্দ। আকাশে মাঝেমাঝে আগুনের ফুলকি জ্বলে উঠছে।লেখিকা ছুটে গেলেন ছাদে। সেখান থেকেই দেখা গেলো বাড়ির দক্ষিণ দিকের মাঠ পেরিয়ে ইকবাল হল, মহসীন হল, আরো কয়েকটা হল আর ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারের কয়েকটা বিল্ডিং। সেখান থেকেই ভেসে আসছে সহস্র কন্ঠের আর্তনাদ-চিৎকার। দূরেদূরে আগুনের আভা দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন দিক থেকে গোলাগুলি,মেশিনগানের শব্দ আসছে। উত্তরে, দক্ষিণে, পূর্বে, পশ্চিমে সবদিকেই আগুনের স্তম্ভ ক্রমেই স্পষ্ট ও আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে।ভয়েভয়ে কাটালেন পুরো রাতটা। মাঝখানে রুমি মার্কস, এঙ্গেলসের বই, মাও সে তুংয়ের মিলিটারি রচনাবলি বইসমূহ প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে প্রতিবেশীর বাউন্ডারির কারনে তৈরী হওয়া কোটরে রেখে আসলেন।
কামাল আতাউর নামের ঢাবির ছাত্র যখন কাঁপাকাঁপা কন্ঠে ডাকলো, তখন ঘড়িতে সময় ভোর ৬টা। তার মুখে শোনা গেলো ইকবাল হল, এসএম হল মেশিনগানের গুলিতে গুড়িয়ে দিয়েছে। সকাল সাড়ে নটায় ঘোষণা হলো অনির্দিষ্টকালের কারফিউ। গতরাত থেকেই ফোনের লাইন ডেড।আর সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ চলে গিয়ে যেন অনিষ্ঠের ষোলকলা পূর্ণ করে দিলো। এ রাতেও শোনা গল গোলাগুলির শব্দ, দেখা গেল আগুনের স্তম্ভ আর ধোয়ার কুন্ডলী। পরেরদিন সকাল সাড়ে আটটায় কারফিউ তোলার ঘোষণা হলো। লেখিকা বেরিয়ে পড়লেন গাড়ি করে, উদ্দেশ্য মায়ের বাসা আর সঙ্গে আছে রুমি। এবার দেখা গেলো নির্মমতা। নিউমার্কেটের কাঁচাবাজার পুড়ে ছাই, সঙ্গে মানুষের লাশও পুড়েছে।শহীদমিনারের রোডে গিয়ে দেখা গেলো, শহীদমিনার গুড়িয়ে দিয়েছে। হাসপাতালে যেতেই খবর মেলে স্ট্যাটিস্টিক্সের মনিরুজ্জামান স্যারকে মেরে ফেলেছে।তাছাড়া শোনা যাই আরো কিছু নির্মমতার গল্প। ঠিক গল্প না, বাস্তবতা। শোনা গেলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী মধুর ক্যান্টিন আর নেই,সাথে পুড়িয়ে মেরেছেন মধু দাকে। ডঃ জি.সি. দেব, ডঃ এফ. আর. খান, মিঃ এ. মুক্তাদির সহ মেরে ফেলছেন ঢাবির আরো অনেক শিক্ষককে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বাঙালি পুলিশদের মেরে ফেলেছে। কলকাতা রেডিওতে বলেই দিল নিলীমা ইব্রাহীম আর সুফিয়া কামালকে মিলিটারি গুলি করে মেরে ফেলেছে। পরে অবশ্য এ সংবাদ ভুয়া হিসাবে চিন্হিত হয়। দি পিপল আর ইত্তেফাকের অফিস ও পুড়িয়ে দিয়েছে পাকসেনারা। ঢাকার যত বাজার আছে, বস্তি আছে, সবই আগুনে পুড়ে ছাই, ছাই হয়েছে রায়ের বাজার, ঠাঠারি বাজার আর নয়ারী বাজার। মনের মাঝে যে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তা হলো ২৫এ মার্চের এ ভয়াবহতার শেষ কই? এ প্রশ্নের উত্তর হাতড়িয়েও কোন উত্তর মেলে না। শুধু দেখা যাই, একগাদা লোক শহর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে প্রাণের শহর ঢাকা ছাড়ছে।
শহীদ রুমি |
২ . দিলাম তোকে দেশের জন্য বলি!
রুমির সাথে কয়েকদিন ধরে তর্ক-বিতর্ক চলছে। লেখিকা বুঝানোর জন্য ২১ এপ্রিল সন্ধ্যায় ডাঃ নাসিরুল হকের বাসায় নিয়ে গেলেন।হলিফ্যামেলি হাসপাতালের ডাক্তার। সেখানে বসেও একই আলোচনা চলছে। লেখিকা বলে চললেন, তোর এখন পড়াশোনার সময়। প্রতিউত্তরে রুমি জানালো, ছাত্রজীবনে পড়াশোনা করার সময় চিরন্তন সত্য কিন্তু সেটা ১৯৭১ সালের জন্য প্রযোজ্য না। লেখিকা বললেন, তুইতো আর এ দেশে পড়বি নাহ। ওহ! রুমি স্কলারশিপ পেয়েছে অ্যামেরিকার " ইলিনর ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে "। রুমি বলেই চললো, আম্মা তুমি জোর করে আমাকে অ্যামেরিকা পাঠাতে চাইল, শেষ পর্যন্ত আমি হয়তো যাবো। চার বছর পর হয়তো ডিগ্রি নিয়ে ফিরবো, অনেক বড় প্রকৌশলী হবো কিন্তু সারাজীবনই বিবেকের কাছে অপরাধী হয়ে থাকবো। মাথা উচু করে বাঁচতে পারবো না কোনদিন। রুমি বলে উঠলো, তুমি কি সেটা চাও? লেখিকা চোখ বন্ধ করে বলে উঠলো, যা দিলেম তোকে দেশের নামে কোরবানি করে।
শহীদ জননীর জন্মদিনে, লিওন উরিসের লেখা "মাইলা ১৮" নামে একটি বই উপহার দিয়ে, রুমি সুখবর দিল তার যুদ্ধে যাবার সুযোগ তৈরী হয়েছে। বইটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোলিশ ইহুদিদের ওপর নাৎসি বাহিনীর অমানুষিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে পোলিশরা যে অসাধারণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তাকে কেন্দ্র করেই বইটির বিষয়বস্তু আবর্তিত। মাকে বললো, বইটা পড়লে তোমার মন শক্ত হবে কেননা জাতি পালটে দিলে মনে হবে পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙালিদের ওপর নির্যাতন করছে।
১৯৭৫ সালের জাহানারা ইমাম |
৩ . মায়ের কোলে ফিরে এলো রুমি
৮ আগষ্টের সন্ধ্যাতে জাহানারা ইমামের মনে যেন দক্ষিণার হাওয়া দোলা দিয়ে গেলো।লেখিকার ভাই লালু খবর এনেছে, রুমি এখন তাদের বাড়ি। শরিফ, জামি রুমিকে আনতে বের হলো। লেখিকা মনে মনে ভাবছে, এখন যেনো বেড়াতে বা ফোন করতে কেউ না আসে।
অপেক্ষা যেনো আর ফুরায় না। এ অপেক্ষা যেনো হাজার বছরের। মায়ের কোলে সন্তানের ফেরার অপেক্ষা। অবশেষে আরো কিছুক্ষণ পরে গাড়ি আসার শব্দ হলো। রুমি এসেছে! তবে যে রুমিকে দেখা গেলো, তাকে মাস খানেক আগের রুমির সাথে মেলানো যাই না। মুখভর্তি দাড়ি, ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল, গায়ের রং তামাটে রোদে পুড়ে কালচে, দুই চোখে উজ্জ্বল ঝকঝকে দৃষ্টি! এ রুমিকে রুমির সাথে মেলানোর ব্যর্থ চেষ্টা লেখিকা করে গেলেন।
রাতের খাওয়া-দাওয়ার পরে রুমি বলতে বসলো তার কাহিনী। কাহিনী অনেকটা রুপকথার গল্প। রুমি শুরু করলো মেলাঘরের গল্প। ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সকল শিক্ষার্থী, ধানমন্ডি-গুলশানের বড়লোক বাপের গাড়ি হাকানো ছেলেরা, খেলার মাঠের চৌকস ছেলেরা। সবাই আজ একই সূত্রে বাধা। ঢাকা জেলাকে সেক্টর-২ এর আন্ডারে আনার ফলে সবাই গিয়ে জড় হয়েছে আগরতলা বর্ডারে। পরিচিত বেশ কয়েকজনের সাথেও দেখা হয়েছে রুমির। আরো বললো কেমন করে বর্ডার ক্রস করে হাসপাতাল লুট করেছিল আবার একটা চিঠিও লিখে রেখে এসেছিল। যেখানে লেখা ছিল," বাংলাদেশি সৈন্যদের ব্যবহারের জন্য নেওয়া হলো"। সকলের মনে হতে শুরু করলো বেতারে শোনা যুদ্ধের গল্পে যেনো রুমির মুখে শোনা গল্পের মতো প্রশান্তি ছিল না।
ওরা থাকতো টিলার ওপর বেড়ার ঘরে আর তাবুতে করে। খাওয়া-দাওয়া বলতে ভাত-ডাল,নাবড়া আর কখনো কখনো মাছ। সকালে খেতো রুটি আর ঘোড়ার ডাল। সে রুটিতে আবার মাঝেমাঝে পোকামাকড় ও থাকতো। সেসব খাবারই রুমির কাছে মনে হতো অমৃত।
গেরিলা ট্রেনিং নিয়েছে রুমি। ঢাকা এসেছে অর্পিত কিছু কাজ সম্পন্ন করতে।
৪. কেড়ে নিল ওরা সাত রাজার ধন
চারদিন আগে, রুমি চাপা উত্তেজনায় বলেছিল ১৮ নাম্বার রোডে ৭-৮ টা খানসেনা মেরে এসেছে।মিলিটারি জীপ পিছু নিয়েছিল।পেছন থেকে গাড়ির কাচ ভেঙে গুলি করেছিল রুমি, সাইডফায়ার করে স্বপন আর বদী। সাথে সাথে জীপ উল্টে যাই মিলিটারিদের।
এ ঘটনার জের ধরে, আজ ২৯ আগষ্টের রাতে ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের নেতৃত্বে পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলেছে মিলিটারি দল। কোথাও দিয়ে পালানোর কোন জায়গা নেই। দরজা খুলে দেওয়া হলে কিছুক্ষণ ধরে ঘর সার্চ করে রমনা থানাতে ইন্টারোগেশনের কথা বলে নিজেদের গাড়িতেই নিয়ে যাওয়া হয় রুমি-জামি-শরীফ-হাফিজকে।
এক বিহারী সুবেদার বলেছিল, একঘন্টা পরেই ওরা ফিরে আসবে। কিন্তু একঘন্টা পেরেলো,দুইঘন্টা পেরেলো, রাত পেরিয়ে ভোর হলো তবু ফিরে আসলো নাহ।আটটার সময় হাফিজ ফিরে আসে তখন জানা যাই রুমিকে অন্য গাড়িতে তুলেছিল।ওদেরকে নিয়ে যাই এয়ারপোর্টের উল্টো দিকে এম.পি.এ. হোস্টেলে। সেখানে একটা ঘরে আটকে রেখে সারা রাত মারধর করে।
৩১ আগষ্ট সকাল ১১ টার দিকে এম.পি.এ হোস্টেলে গিয়ে উপস্থিত জাহানারা ইমাম।দেখা হয়ে গেলো সুবেদার গুলের সাথে।তিনি জানালেন, ইন্টারোগেশনের কারনে দেখা করা যাবে নাহ। তাই বাধ্য হয়েই এক প্যাকেট স্যান্ডউইচ, সবার জন্য এক সেট কাপড় দিয়ে আসলেন গুলের হাতে। কিন্তু বাসায় ফেরার কিছুক্ষণ পরেই দেখলেন বাইরে দাড়িয়ে আছে সাদা হিলম্যান মিংকস। শরীফ, জামি,মাছুম ফিরে এসেছে।
গত দুই দিন ধরে ওদের ওপর চলেছে অমানবিক নির্যাতন। বুকে ঘুষি, পেটে লাথি,হঠাৎ করে আচমকা পেছন থেকে ঘাড়ে রদ্দা - সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় চোখগুলো বেরিয়ে গেলো, রাইফেলের বাট দিয়ে বুকে-পিঠে গুতা, উপুড় করে শুইয়ে বুটসুদ্ধ পায়ে উঠে দাড়িয়ে মাড়ানো, বিশেষ করে কনুই, কবজি, হাটুর গিটগুলো থ্যাতলানো, কাউকে আবার সারারাত চলন্ত ফ্যানের সাথে পা বেধে রাখা হতো।
ওরা কেউই রুমির কথা বলতে চাই না।জামিকে জোর করার পর বলে ভাইয়া বলেছিল,"তুইতো জানিস আমি বাইরে থেকে কতটা টাফ কিন্তু ভেতরটা মনে হচ্ছে চুরচুর হয়ে গেছে।
জামি, শরীফ, মাছুম রুমিকে শেষ দেখেছিল ৩০ তারিখ দুপুরে! তারপর আর দেখনি।রুমিও আর কখনো ফেরেনি।
শহীদ জননী |
৫. কেনো তিনি শহীদ জননী?
★ রুমি গেরিলা ট্রেনিং নিয়েছিল মেলাঘরে। সেখান থেকে মাঝেমাঝেই আসতো জিয়া, মনু, দুলু আর পারভেজদের মতো তরুন গেরিলারা। পারভেজ এসে যখন বলেছিল, মেলাঘরে কি একটা চোখের রোগের প্রকোপ বেড়েছি যা কিনা"হোমিওপ্যাথি বেলডনা-৬" নামের ঔষধে সেরে যাচ্ছে।পরে তিনি একগাদা কিনে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
★ রুমি তখন মেলাঘর থেকে ঢাকায় ফিরেছে। বাসায় কখন আসে আর কখন বের হয়ে যাই তার কোন সময়-অসময় নেই। সঙ্গে করে দুই-তিনজন বন্ধু নিয়ে আসে।বদী, জুয়েল, আজাদরাও রুমির সহযোদ্ধা। জাহানারা ইমাম কি করবেন ভেবে পান না! তাই ফ্রিজ ভর্তি খাবার রান্না করে রেখছেন যাতে করে ওরা যখনই আসুক খাবার এনে সামনে দিতে পারেন।
★ ২৫ আগস্টের অপারেশনের পর অস্ত্রসস্ত্র লুকিয়ে রাখা হলো রুমিদের বাড়ির উঠানের পানির হাউজের নিচে। আর সেকাজে প্রত্যক্ষভাবেই সাহায্য করলেন শহীদ জননী।
★ অক্টোবর মাস! দেশ জুড়ে যুদ্ধ এখন পুরোদমে শুরু হয়েছে। শহীদ জননী তাই নিউমার্কেট থেকে ঔষধ কিনে রেখেছেন। সেগুলোকে নিজেই আবার ছোটছোট প্যাকেটে রেখেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা আসলে তাদের কাছে অল্প অল্প করে দিয়ে দেন। বেশী দিতে পারেননা কেননা একটু দূরেদূরেই মিলিটারি চেকপোস্ট রয়েছে।
★ শীত এসে গেছে। নিউমার্কেট থেকে অল্প অল্প করে ছেলেদের জন্য গরম কাপড় কিনে রাখছেন। কেউ আসলেই পাঠাতে হবে মেলাঘরে। রুমির মেলাঘরে।
উৎস:
একাত্তরের দিনগুলি-জাহানারা ইমাম
0 Comments
Post a Comment