"দূর দ্বীপবাসীনি, চিনি তোমারে চিনি, দারুচিনিরো দেশে, তুমি বিদেশীনিগো সুমন্দভাসীনি " প্রকৃতি মানুষকে উদার হতে সাহায্য করে। তাইতো জীবনকে উপভোগ করতে হলে আপনাকে অবশ্যই যেতে হবে প্রকৃতির সান্নিধ্যে। মনকে ভালো রাখতে তাই প্রকৃতির বিকল্প নেই। এইজন্যই প্রকৃতিকে ভালোবেসে কবি সাহিত্যিকরা লিখেছেন অসংখ্য কবিতার লাইন। প্রকৃতিকে ভালোবেসে হুমায়ূন আহমেদ সেন্টমার্টিনে বানিয়েছেন 'সমুদ্র বিলাস'। বাংলাদেশ প্রকৃতির সৌন্দর্যের অপার লীলাভুমি। এর মধ্যে সেন্ট মার্টিন যেন শিল্পীর তুলিতে আকা এক স্বপ্ন দ্বীপ। সেন্টমার্টিনের সৌন্দর্য যে কেউকে মুহূর্তেই রোমাঞ্চিত করে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পাগলা হাওয়া প্রকৃতি প্রেমিকের জীবনকে সত্যিকার ভাবে রাঙ্গিয়ে দেয়।
প্রবাল দ্বীপ সেইন্ট মার্টিন ছবিঃ উইকিমিডিয়া |
সেন্টমার্টিনকে নিয়ে গল্প কাহিনীর অন্ত নেই। সেন্টমার্টিন হল একটি ছোট দ্বীপ যা বাংলাদেশের সীমানার সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত। অপরুপ সৌন্দর্য অবলোকন ও ভ্রমণের জন্য একটি আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা। এটি বঙ্গোপসাগরের উওর-পূর্ব অংশে এবং টেকনাফ থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মিয়ানমারের উপকূল হতে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত। সেন্টমার্টিনকে বাংলাদেশের একমাএ প্রবাল দ্বীপ বলা হয়। এর আয়তন ৮ বর্গ কিলোমিটার। ২০০৬ সালের হিসেব অনুযায়ী এর জনসংখ্যা ৭,০০০ জন। এবং এর ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৮৭৫ জন।
চারপাশে সমুদ্র। নীলজল খেলা করছে। সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে সোনালী বালির উপর। এরই অঅববাহিকায় নাকি ৭০০০ মানুষের বসবাস। ভাবলেই নিজেকে সেন্টমার্টিনের অধিবাসী বলে দাবি করতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এই সেন্টমার্টিন দ্বীপের সৃষ্টি কিভাবে হল এবং বাংলাদেশের অংশ কেন হল এটা অনেকের কাছেই অবগত নয়।
সেন্টমার্টিনের নামকরন যেভাবে হল:
সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি নারকেল জিঞ্জিরা হিসেবে পরিচিত। কিছু আরব বণিক এই দ্বীপটির নামকরণ করেছিল জিঞ্জিরা। উল্লেখ্য এরা চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যাতায়াতের সময় এই দ্বীপটিতে বিশ্রামের জন্য ব্যবহার করতো। কালক্রমে চট্টগ্রাম এবং তৎসংলগ্ন মানুষ এইদ্বীপটিকে জিঞ্জিরা নামেই চিনতো। পরবর্তীতে যেটি নারিকেল জিঞ্জিরা নামে পরিচিত হয়। তাছাড়া প্রচুর নারকেল পাওয়া যায় বলে এ নামটি অনেক আগে থেকেই পরিচিত হয়েছে। প্রচলিত আছে, খ্রিস্টান সাধু মার্টিনের নাম অনুসারে দ্বীপটির নামকরণ করা হয়। বাঙালি জেলেরা জলকষ্ঠএবং ক্লান্তি দূরীকরণের অবলম্বন হিসাবে প্রচুর পরিমাণ নারকেল গাছ এই দ্বীপে রোপণ করেছিল। কালক্রমে পুরো দ্বীপটি একসময় 'নারকেল গাছপ্রধান' দ্বীপে পরিণত হয়। এই সূত্রে স্থানীয় অধিবাসীরা এই দ্বীপের উত্তরাংশকে নারিকেল জিঞ্জিরা নামে অভিহিত করা শুরু করে। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯০০ সালে ভূমি জরিপের সময় এ দ্বীপটিকে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। যদিও সে সময়টিতে বার্মা ব্রিটিশ শাসনের আওতায় ছিল। কিন্তু তারপরেও সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে বার্মার অন্তর্ভুক্ত না করে ব্রিটিশ-ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। আর দ্বীপটিকে যখন ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মার্টিনের নাম অনুসারে দ্বীপটির নামকরণ করা হয়।
নারিকেল জিঞ্জিরায় পড়ন্ত বেলা ছবিঃ উইকিমিডিয়া |
প্রায় ৫০০০ বছর আগের কথা। তখন এই জায়গাটি (সেন্টমার্টিন দ্বীপ) ছিল টেকনাফের মূল ভূমির অংশ। কিন্তু কালক্রমে এটি সমুদ্রের ভয়াল গ্রাসে হারিয়ে যায়। টেকনাফ থেকে আলাদ হয়ে যায় প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন। তবে আলাদা হয়ে গেলেও নিজের অস্তিত্ব খানিকটা বাঁচিয়ে রেখেছিল সেন্টমার্টিন। প্রায় ৪৫০ বছর আগে বর্তমান সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ পাড়া জেগে উঠে। তারপর খুব কম সময়ে উত্তর পাড়া এবং পরবর্তী ১০০ বছরের মধ্যে বাকি অংশ জেগে উঠে। ২৫০ বছর আগে আরব বণিকদের নজরে আসে এ দ্বীপটি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে বাণিজ্যের সময় আরব বণিকরা এ দ্বীপটিতে বিশ্রাম নিতো। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কিছু বাঙালি এবং রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ এই দ্বীপের বসতি স্থাপনের জন্য আসে। এরা ছিল মূলত মৎস্যজীবি। প্রথম অধিবাসী হিসাবে বসতি স্থাপন করেছিল ১৩টি পরিবার। তারা বসবাসের জন্য দ্বীপের উত্তরাংশে নিজেদের কলোনি স্থাপন শুরু করছিল। এই দ্বীপের প্রায় ৫,৫০০ লোক মাছ ধরার পেশায় নিয়জিত। কালক্রমে দ্বীপটি বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হয়।
সেইন্ট মার্টিন দ্বীপের মানচিত্র |
সেন্টমার্টিন দ্বীপের আয়তন প্রায় আট বর্গকিলোমিটার ও উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। এ দ্বীপের তিন দিকের ভিত শিলা, যা জোয়ারে তলিয়ে যায় এবং ভাটার সময় জেগে ওঠে। এগুলোকে ধরলে এর আয়তন হবে প্রায় ১০-১৫ বর্গকিলোমিটার। দ্বীপটি উত্তর ও দক্ষিণে প্রায় ৫.৬৩ কিলোমিটার লম্বা। দ্বীপের প্রস্থ কোথাও ৭০০ মিটার আবার কোথাও ২০০ মিটার। দ্বীপটির পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত অগণিত শিলাস্তূপ আছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের গড় উচ্চতা ৩.৬ মিটার। পাওয়া যায় সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ১২০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়।
পরিষ্কার স্বচ্ছ পানি। কোথাও নীলাভ রং, কোথাও বা হালকা সবুজ আভা। যত দূর চোখ যায়, পানির নিচের সবকিছুই স্পষ্ট। কখনো বা বিভিন্ন রঙের ডোরাকাটা রঙিন মাছ দেখা যাচ্ছে, কখনো বা সবুজ কোরাল, ব্রেইল কোরাল উঁকি দিচ্ছে। প্রকৃতির এমনই অপরুপ সৌন্দর্যের আধার প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন ।
0 Comments
Post a Comment