খালিদ বিন ওয়ালিদের কথা মনে আছে। ইসলামের একের পর এক যুদ্ধ জয় করে নিজেকে গড়ে তুলেছিলন এক অপরাজেয় সৈনিক হিসাবে। যে কিনা জীবনের শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত  ইসলামের জন্য  লড়েছেন একের পর এক যুদ্ধ।কিংবা বসুসেন কে চেনেন? মহাভারতের বসুসেন। অবশ্য চেনার কথা নয়। তিনি কর্ণ  নামেই অধিক পরিচিত। এবার চিনেছেন? মহাবীর কর্ণ। প্রতিপক্ষের আক্রমণের পর আক্রমণে  পর্যদুস্ত হয়েও যিনি কখনোই  হার মেনে নেননি। লড়াই করেছেন নিজের মতো করে। শুধু তাই নয়, কুরুক্ষেত্রে শরীরে শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত লড়াই করেছেন। 
ক্রিকেটের বাইশ গজেও  দেখা মিলেছে  খালিদ-কর্ণদের লড়াইয়ের।  ক্রিকেট মাঠের লড়াই তলোয়ার আর বোমা-বারুদের নয়। ক্রিকেটের যুদ্ধ  বৈরী পিচে বোলারের সুইং-গুগলির তোপ উপেক্ষা করে ব্যাটসম্যানকে সারাদিন মাটি কামড়ে ব্যাট হাতে দাড়িয়ে থাকতে হবে। এ লড়াইয়ে কখনো কখনো আঘাতপ্রাপ্ত হতে হয়েছে বহু ক্রিকেটারকে। তাদের অনেকেই মাঠে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন কিন্তু দলের প্রয়োজনে আবার লড়াই করেছেন অদম্য সাহসে। 

"ম্যা খেলেগা, ম্যা খেলেগা"- বিশ্ব শাসনের এক আগমনী বার্তা
ছবিঃ উইকিমিডিয়া 


১৯৮৯ সালের কথা। ভারতীয় ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফর।  কিন্তু সে সময়ে ভারতীয় বোর্ডের (বিসিসিআই) সাথে স্নায়ুযুদ্ধ  চলছে কিছু সিনয়র খেলোয়াড়ের। পাকিস্তান সফরে তারা যাবে কিনা তা নিয়েও সংবাদমাধ্যমে বেরিয়েছে বিভিন্ন গুন্জন। যদিও কিছুদিন বাদে সবকিছু উড়িয়ে দিয়ে ঘোষণা হয় পাকিস্তান সফরের স্কোয়াড।সে দলে জায়গা হয় আনকোরা ধাচের দুই ক্রিকেটারের। একজন তো আবার মাত্র ১৬ বছর বয়সী। বয়স হিসেবে অনূর্ধ্ব-১৭ কিংবা অনূর্ধ্ব-১৯ দলেই খেলার  কথা ছিল যে ছেলেটার, সে কিনা জায়গা পেল পাকিস্তান সফরে। অনেকে তো মেনে নিতেই পারছে না, এ ছেলে ওয়াসিম-ইমরানদের মোকাবেলা কিভাবে করবে! 

অবশ্য দলে নেওয়ার অন্যতম কারনগুলোর একটি হলো কৈশর না পেরেনো ছেলেটি পুরো ভারতজুড়ে পরিচয় পেতে শুরু করেছে বিস্ময় বালক হিসেবে। সে সময়ে  স্কুল ক্রিকেটে বিনোদ কাম্বলির সাথে গড়েছেন  ৬৬৪ রানের রেকর্ড পার্টনারশিপ। মুলত তারপরেই পুরো ভারতেই ছড়িয়ে পড়েছিল তার নাম। আচ্ছা ,  এখনো ছেলেটির নামই বলা হয়ে ওঠেনি। ছেলেটির নাম শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। 
অভিষেকে রন্জী ট্রফিতে করেছেন সেঞ্চুরি। তাও আবার সবচেয়ে কম বয়সে। ইরানি ট্রফিতে ও অভিষেকে সেঞ্চুরি। অনেকেই ধারনা করেছিলেনও ইন্ডিয়া ক্রিকেটের "নেক্সট দ্যা বিগ থিং" হতে যাচ্ছেন  শচীন নামের এই টিন এজার। যার ব্যাটিং দ্যুতি দেখে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন  সুনীল গাভাস্কার-কপিল দেবদের মতো ইন্ডিয়ান বিগ ফিশ। এতো কিছুর পরও শঙ্কা থেকেই যাই মাত্র ১৬ বছর বয়সী এক টিন  এজার মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান  ওয়াসিম-ইমরান-কাদিরদের নিয়ে সাজানো বিশ্বসেরা বোলিং লাইনআপের সামনে দাড়াতেই পারবে কিনা! ঝুঁকিটা নিলেন নির্বাচক কমিটি, যার প্রধান ছিলেন রাজ সিং দুঙ্গারপুর। সব শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে পুরো স্কোয়াডের সাথে শচীন রমেশ টেন্ডুলকার ও উড়েছিল পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে।
চার টেস্টের সিরিজের প্রথম ম্যাচেই অভিষিক্ত হন শচীন। নভেম্বরের ১৫ তারিখে পেয়ে যান একজন ক্রিকেটারের লালিত স্বপ্নের টেস্ট ক্যাপ। তবে সে ম্যাচে মাত্র ১৫ রানেই ফিরে যান  শচীন। সিরিজের প্রথম তিন ম্যাচই থেকে যাই অমীমাংসিত। অনেকটা সাদামাটা ধাচের ব্যাটিংয়ে প্রথম তিন ম্যাচে একটা পঞ্চাশ  পেরেনো ইনিংসে করেন ১২৩ রান। যে জিতবে, সিরিজ তার। এমন সমীকরণ মাথায় নিয়ে শিয়ালকটে চতুর্থ টেস্ট খেলতে নামে ভারত-পাকিস্তান উভয়দল।

"ম্যা খেলেগা, ম্যা খেলেগা"- বিশ্ব শাসনের এক আগমনী বার্তা
১৬ বছর বয়সী শচীন  


প্রথম দিন

"কিং অফ সুইং" খ্যাত ওয়াসিম আক্রামের বোলিং তোপে শিয়ালকোটের সকালটা শুরু হয়েছিল পাকিস্তানময়। ২০ রানের মাথায়  মাত্র ১০ রান করা শ্রীকান্তকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলেন  আর ৩৯ রানের মাথায়  ১২ রান করা নভোজিৎ সিধুকে রমিজ রাজার তালুবন্দি করে  প্যাভিলিয়নের পথ দেখান ওয়াসিম আক্রাম। শুরুর ধাক্কাটা সামাল দেন  ম্যান্জেকর আর আজহারউদ্দীন মিলে। এ সিরিজেই অভিষিক্ত ওয়াকার  ইউনিস পাকিস্তানকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে ওয়াসীম-ওয়াকার-ইমরান ত্রয়ী গড়ে তোলার।  কিন্তু এ ত্রয়ীকে সারা দিনেই হতাশাই ভাসান  ম্যান্জেকর-আজহারউদ্দীন জুটি। ১২৮ রানের জুটি গড়ার পথে দুজনেই তুলে নেন  ব্যক্তিগত অর্ধশতক। কিত্ত দলীয় ১৬৭ রানের মাথায় ব্যক্তিগত ৫২ রানে কাঁটা পড়েন আজহারউদ্দীন  রানআউটের স্বীকার হয়ে। দিনশেষে ভারতের সংগ্রহ   ১৮১/৩। মান্জেকার অপরাজিত ৭২ রানে সঙ্গে আছে রবি শাস্ত্রী  ব্যক্তিগত ৫ রানে।

দ্বিতীয় দিন

কেনো ওয়াকার ইউনিসকে  নিয়ে গড়ে তোলা হবে  নতুন ত্রয়ী! সেটা প্রমাণ করলেন দ্বিতীয় দিনের শুরুতেই। দ্বিতীয় দিনে কোন রান যোগ না করেই লেগবিফোরের ফাঁদে পড়ে ফিরে গেলেন স্যান্জে ম্যান্জেকর। এরপরে আর তেমন কোন জুটি গড়ে তুলতে পারেনি ভারতীয় দল। নিয়মিত বিরতিতে হারাতে থাকে একের পর এক উইকেট। ১৮১/৩  নিয়ে দিন শুরু করা ভারত অলআউট হয় ৩২৪ এ ।

দ্বিতীয় দিনেই পাকিস্তানের হয়ে  প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নামে আমির মালিক আর রমিজ রাজা। আমির মালিক প্রভাকরের বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়ে আউট হন ৯ রানে। দিনশেষে পাকিস্তানের সংগ্রহ  ১ উইকেটে ২৩।

তৃতীয় দিন

তৃতীয় দিনে এসে কেনো যেন মনে হচ্ছে পাকিস্তান দল টেস্ট জয়ের থেকে ড্র এর দিকে এগোতে চাচ্ছে। মাটি কামড়ে পড়ে থাকাই যেনো তাদের লক্ষ। তাছাড়া রাজদানের বোলিং তোপে একে একে রমিজ রাজা, শোয়েব মোহাম্মদ, সেলিম মালিকরা বিদায় নিয়েছেন। দিনশেষে পাকিস্তানের সংগ্রহ  ১৮১ /৫। ইমরান খান অপরাজিত ২১ রানে আর সঙ্গে  আছেন নাদিম আব্বাসি ৭ এ।

"ম্যা খেলেগা, ম্যা খেলেগা"- বিশ্ব শাসনের এক আগমনী বার্তা
শচীন ও আজাহা উদ্দিন 

চতুর্থ দিন

দিনের শুরুতেই প্রভাকরের বলে ফিরে যান ইমরান খান। এরপর আর কেউই তেমন করে ভারতীয় বোলিং আক্রমণের সামনে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। ২৫০ রানের মাথায় পাকিস্তানের  কফিনে শেষ পেরেক গেড়ে দেন কপিল দেব।
দ্বিতীয় ইনিংসে ভারতের হয়ে যথারীতি  ব্যাটিংয়ে নামে  শ্রীকান্ত-সিধু জুটি। এরপরই শুরু হয়  ওয়াসিম-ইমরান জাদু। মাত্র ৩৮ রানেই গুড়িয়ে দেয় ভারতের টপঅর্ডারকে। গুনেগুনে প্যাভিলিয়নের পথ দেখান টপ অর্ডারের চার ব্যাটসম্যানকে।শূন্যমুখে ফিরে যান শ্রীকান্ত, ম্যান্জেকর, আজহারউদ্দীন, রবি শাস্ত্রীর মতো ব্যাটসম্যানরা।

 এরপরেই ব্যাটিংয়ে নামেন শচীন নামের টিন এজার ছেলেটি। প্রাথমিক ধাক্কা সামাল দেন নভজিৎ সিধুকে নিয়ে। সবাই যখন  ম্যাচ হারার চিন্তায় শঙ্কিত, ১৬ বছরের শচীন তখন ম্যাচ বাঁচাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দিন শেষে  ভারতের সংগ্রহ ঐ ৪ উইকেটে ১০৭। নভজিৎ সিধুর ৫৪ এর সাথে শচীনের ৩৩।

৫ম দিন

শচীন ম্যাচ বাঁচাতে কতোটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তা বোঝা যাই টেস্টের পঞ্চম দিনে।শচীন তখন ৩৬ রানে ব্যাট করছে, পুরো সিরিজ জুড়েই শচীনকে ভোগানো ওয়াকার আবার ও বোলিংয়ে। দিনের তৃতীয় ওভারে বোলিংয়ে এসেই বাউন্সার। ক্রিকেটের ভাষায় যাকে এক কথায় বলে "ন্যাস্টি বাউন্সার"। গতি ঘন্টায় ১৫০ কিলোমিটার যা আঘাত করে শচীনের নাকে। সে এক রক্তারক্তি ব্যাপার। শচীন হাটু গেড়ে বসে পড়েন। ননস্ট্রাইক প্রান্ত থেকে এগিয়ে আসেন সিধু! দৌড়ে মাঠে প্রবেশ করেন ফিজিও থেরাপিস্ট।পাকিস্তানের সকল প্লেয়ার ও ছুটে আসে। গ্যালারী  থেকে উৎসুক সমর্থক ও চুপচাপ বনে গেছেন। মাঠের ভেতরেই শুরু হলো শচীন টেন্ডুলকারের প্রাথমিক চিকিৎসা।
নভোজিৎ সিধু শচীনকে বলেন, "তুমি প্যাভিলিয়নে গিয়ে বিশ্রাম নাও , ১-২ ঘন্টা  পরে আবার এসো, দরকার হলে হাসপাতালে যাও"। ফিজিও থেরাপিস্ট বোঝানোর চেষ্টা করলেন, প্যাভিলিয়নে ফিরে চলো, যখন স্পিনার আসবে তখন আবার এসো। কিন্তু  শচীন টেন্ডুলকার মৃদু কন্ঠে  বলে উঠলেন, "ম্যা খেলেগা, ম্যা খেলেগা "। স্বয়ং নভোজিৎ সিধুও এ কথা বিশ্বাস করতে পারেনি, চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন এ ছেলে বলে কি! মনে মনে ভাবছেন, মরেই যাবে বোধহয়।

শচীন উঠে দাড়ালেন। ভাঙা নাক নিয়েই শুরু করলেন খেলা। ওয়াকারের পরের বলেই লংঅনে  সজোরে ব্যাট চালালেন।চার রান। আঘাতের পরে যেন নিজেকে নতুন উদ্যমে ফিরে পেলেন। আরো কয়েক ঘন্টা  মাঠে ছিলেন। যতক্ষণ ছিলেন ছড়ি ঘুরালেন ওয়াসিম-ওয়াকার-ইমরান ত্রয়ীর উপর।  যতক্ষণে  ইমরান  খানের বলে উইকেটরক্ষক  নাদিম আব্বাসির তালুবন্দী হলেন, ততক্ষণে নভোজিৎ সিধুর সাথে গড়ে ফেলেছেন ১০১ রানের জুটি। ভারত দ্বিতীয়  ইনিংসে লিড পেয়ে গেছে ২১৩ রানের। শচীন প্যাভিলিয়নে ফিরলেন ব্যক্তিগত ৫৭ রানে। মোকাবেলা করলেন মুল্যবান ১৩৪ টা ডেলিভারি ।এতক্ষণে অবশ্য  শিয়ালকোটের দর্শকসহ পুরো বিশ্বের ক্রিকেটপ্রেমীদের মন জয় করে নেয় সে সময়ের টিন  এজার শচীন রমেশ টেন্ডুলকার।  শচীন তার ব্যাটিং বীরত্বে  জানান দিলেন, এই ছেলেটিই আগামী ২৫ বছর  ক্রিকেটের বাইশ গজে রাজত্ব করবে।
ভারত দিনশেষে  ৭ উইকেট হারিয়ে  করে ২৩৪। নভোজিৎ সিধু ৯৭ রানে জাকির খানের বলে প্যাভিলিয়নে ফেরেন। চতুর্থ টেস্টের সাথে সিরিজও থাকে অমীমাংসিত।
গণমাধ্যমে ইন্ডিয়ান পেসার মনোজ প্রভাকর বলেন, সবুজ ঘাসের এমন উইকেটে তা আবার বিশ্বের সেরা  পেস আক্রমণের বিপক্ষে একটা ১৫-১৬ বছরের ছেলে বুক চিতিয়ে লড়াই করছে, তখন মনে হয়েছিল এই ছেলে লম্বা রেসের ঘোড়া। 

"ম্যা খেলেগা, ম্যা খেলেগা"- বিশ্ব শাসনের এক আগমনী বার্তা
ক্রিকেট ঈশ্বর 


কয়েকবছ পরে ওয়াসিম আক্রাম বলেন,  শচীনকে প্রথম দেখি করাচি টেস্টে ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে। সে টেস্টে ১০-১৫ (১৫) করে আউট হয়ে যাই। পরের ম্যাচগুলাও ভালো  করতে পারে নাই। কিন্তু শেষ টেস্টে যখন মুখে ব্যান্ডেজ নিয়েও  ওয়াকেরর পরের বলেই বাউন্ডারি মারে, তখনই বুঝে গেছিলাম, এই ছেলে রাজত্ব করবে। 
ইমরান খান গণমাধ্যমে বলেন, ভেবেছিলাম এ ছোট বাচ্চা আর কি করবে যেখানে আমাদের দলে ওয়াকার -ওয়াসিমের মতো পেসার আছে।
কে বা ভেবেছিল, একটা ১৬ বছরের বাচ্চা  টেস্টের ৫ম দিনে বিশ্বের সেরা পেস আক্রমণের সামনে ভাঙা নাক নিয়ে বুক চিতিয়ে লড়বে তা আবার পুরোপুরি  সবুজ ঘাসের উইকেটে। কিন্তু গ্রেটরা এমনই হয়,  সাধারণ মানুষের কাছে যা অভাবনীয়, তারা করে অনায়সে।