ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান: প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের সৃষ্টি কথা
ব্যবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান
ছবিঃ উইকিমিডিয়া 
সত্যিকারের প্রেম মানুষকে মহান করে তোলে, অনুপ্রেরণা যোগায় আশ্চর্যজনক কিছু করতে। তারই প্রমান আগ্রার তাজমহল,  ব্যবলিনের শূন্য উদ্যান বা ঝুলন্ত উদ্যান। সৌন্দর্যমন্ডিত এই ধরনের প্রতিকৃতি গুলো নির্মানের পেছনে রয়েছে প্রেমিক মনের অফুরন্ত ভালোবাসার কাহিনী। মিডিয়ান রাজকন্যার সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে প্রেমে পড়েন সম্রাট নেবুচাদনেজার। প্রেমের শেষ পরিনতি হিসেবে তাদের বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের পর ব্যাবিলনে সম্রাজ্ঞীর তেমন ভালো লাগত না, কারণ ব্যাবিলন হলো সমতল ভূমি আর মিডিয়ান ছিল সবুজ পাহাড়-পর্বতের দেশ। তাই এখানকার প্রকৃতি কোন ভাবেই সম্রাজ্ঞীকে আকৃষ্ট করত না। তাই সম্রাট নেবুচাদনেজার  সম্রাজ্ঞীর মনের কষ্ট বুঝতে পেরে প্রাসাদের ওপরই তৈরি করলেন এক সুন্দর পুষ্প বাগান। যা পরবর্তীতে ব্যাবিলনের শূণ্য উদ্যান বা ঝুলন্ত উদ্যান হিসেবে পরিচিতি পায়।  

ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান: প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের সৃষ্টি কথা
নেবুচাদনেজার ২


খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দের কথা। ইউফ্রেটিস নদীর তীরে গড়ে ওঠা জাঁকজমকপূর্ণ একটি শহর ছিল যার নাম ব্যাবিলন। মেসোপটেমিয় সভ্যতার মধ্যে এই ব্যাবিলনের সভ্যতাই ছিল অন্যতম। সমতল এবং চারকোণা এ শহরটি তখন প্রশস্ত প্রতিরক্ষা প্রাচীরে ঘেরা ছিল, যা উচ্চতা এবং প্রশস্তের দিক থেকে ছিল বিস্ময়কর। প্রতিটি শহর বা রাজপ্রাসাদের মত এই শহরের সামনেও ছিল মজবুত ও উঁচু প্রবেশ পথ। আর শহরের ঠিক মাঝখানে একটি বড় স্তম্ভও তৈরি করা হয়েছিল। এই বিশ্রষ স্তম্ভটির নাম ছিল ব্যাবিলন টাওয়ার। এই টাওয়ারটির সঙ্গেই সম্ভবত ব্যাবিলন নামটির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে ।
ব্যাবিলনের এই বাগানটিকে অত্যাশ্চর্য বাগান বলা হয় শুধু একটি কারণে তা হলো- বাগানটিকে দূর থেকে দেখে মনে হতো এটি হাওয়ায় ভাসছে। যার কারণে এটিকে ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যানও বলা হয়েছে, যা প্রাচীন যুগের আকর্ষণীয় সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে একটি। 
হাতে বানানো যে বাগানটি সমগ্র বিশ্বের কাছে পরিচিত এটি খুব সহজে নির্মান করা সম্ভব হয়নি। বাগানটি নির্মাণের জন্য প্রথমে স্থাপন করা হয় এক বিশাল ভিত, যার আয়তন ছিলো ৮০০ বর্গফুট। আর এই ভিতটি নির্মান  করা হয়েছিলো সরাসরি তৎকালীন সম্রাটের খাস উপাসনালয়ের বিস্তৃত ছাদের উপর। স্থাপনের পর ভত্তিটিকে দেওয়া হয়েছিল পাহাড়ের আকৃতি, ভূমি থেকে যার উচ্চতা দাড়িয়েছিল ৮০ ফুট। এই উচ্চতার জন্যেই হয়তো ঝুলন্ত তকমাটি লেগেছিল ব্যাবিলনের এই উদ্যানে। তবে রাতারাতি হয়ে উঠেনি এই অপূর্ব বাগানটি। ৪ হাজার শ্রমিক রাতদিন পরিশ্রম করে তৈরি করেছিলো এই বাগান।  সম্রাজ্ঞীর পাহাড়ি পরিবেশ পছন্দ ছিল তাই তিনি প্রথমেই পাহাড়ের মতো একটি জায়গা তৈরি করলেন। তারপর এই পাহাড়কে বিশেষ কোশলে কয়েকটি তলায় ভাগ করে প্রতিটি তলার চারপাশে বারান্দা তৈরি করলেন, যাতে সম্রাজ্ঞী সহজেই এখানে বিচরন করতে পারেন। পাহাড়ের সঙ্গে সঙ্গে তৈরি করলেন মনোরম বাগান। সারা পৃথিবী থেকে চমৎকার সব উদ্ভিদ আর ফুল এনে সাজিয়ে দিলেন  বিশ্ববিখ্যাত এই বাগানকে। কারণ তিনি চেয়েছিলেন পৃথিবীর সব আনন্দ আর সুখ দিয়ে সম্রাজ্ঞীর জন্য ভালোবাসার নিদর্শন স্থাপন করতে। এই সুবিশাল বাগানটির পরিচর্যার কাজে নিয়োজিত ছিল ১০৫০ জন মালী। অন্তত ৫ থেকে ৬ হাজার প্রজাতির ফুলের চারা এবং বাহারি গাছ রোপণ করা হয়েছিলো এখানে। ৮০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত বাগানে  পানি দেওয়ার জন্য  মোটা পেঁচানো নলের ব্যবহার করা হত।

ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান: প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের সৃষ্টি কথা
ব্যাবিলন শহরের ধ্বংসাবশেষ 
ছবিঃ উইকিমিডিয়া 

কিন্তু এই বিচিত্র বাগান তৈরির পরিকল্পনা প্রথমে সম্রাট নেবুচাদনেজার ছিল না।  তিনি চেয়েছিলেন মুরুভুমিতে গাছ লাগিয়ে একটি সুন্দর বাগান সম্রাজ্ঞীকে উপহার দিতে।  কিন্তু মরুভূমিতে পানি সল্পতার জন্য এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তাই সম্রাট এই বিশেষ পদ্ধতিতে বাগান তৈরির পরিকল্পনা করলেন। 
আশ্চর্য এই বাগানের অস্তিত্ব নিয়ে বিস্ত্রিত অসংখ্য তর্ক বিতর্কের জাল। বেশীরভাগ আধুনিক গবেষকদের ধারণা ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যানের কোন অস্তিত্ব ছিল না। এটি আসলে সাহিত্যিকদের কল্পনার প্রতিচ্ছবি।

ব্যাবিলনের এই বাগানটি সম্পর্কে প্রথম লেখেন ব্যাবলনিয়ান পুরোহিত বেরোসাস খ্রি:পূর্ব ৪০০ সালের দিকে। আর তার লেখাকে ভিত্তি করেই পরবর্তীতে গ্রীক ইতিহাসবিদ গন এই বাগানের সম্পর্কে লেখেন। কিন্তু তাদের কেউই বাগানটি নিজ চোখে কখনো দেখেন নি। বাগানের কোনও অস্তিত্ব বর্তমানে না থাকায় এই মতাদর্শ বেশ প্রচলিত। তাছাড়া যখন বাগানটি তৈরি করা হয় তখনকার কোনও লেখকের বর্ণনায় এই বাগানের কথা পাওয়া যায়নি। এত বড় একটি সৃষ্টি যা ওই সময়ের লেখক বা ইতিহাসবিদদের লেখায় উঠে আসার কথা থাকলেও উঠে আসেনি যার কারনে ব্যাপারটি বেশ ঘোলাটে হয়ে উঠেছে।  

ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান: প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের সৃষ্টি কথা
কল্পিত ব্যবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান
ছবিঃ উইকিপিডিয়া 


তবে ১৮৯৯ সালে  ব্যাবিলন শহরে খনন কাজ শুরু করেন এক জার্মান গবেষক। সেখানে রাজা নেবুচাঁদনেজার এর প্রাসাদ, দুর্গ, টাওয়ার অব ব্যাবিলন এবং নগর রক্ষাকারী দেওয়াল সবই পাওয়া যায় তার খনন কাজে এমন টা-ই দাবি ছিল তার। তিনি ১৪টি রুমবিশিষ্ট একটি ছাদ খুঁজে পান যেটি পাথরের তৈরি। আর ব্যাবিলনের প্রাচীন ইতিহাস অনুযায়ী উত্তর দিকের দুর্গ এবং ঝুলন্ত বাগান ছাড়া আর কোথাও ছাদ তৈরিতে পাথর ব্যবহারের কথা উল্লেখ ছিল না। তাই এই ছাদটিকেই তিনি ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানের ছাদ বলে বাগানের অস্তিত্ব স্বপক্ষে জোরালো প্রমাণ দেয়। কিন্তু এই গবেষকের কথায় দ্বিমত পোষন করেছেন আধুনিক কিছু গবেষকরা। তাদের মতে যে অংশটিকে ঝুলন্ত বাগান বলা হয়েছে তা নদী থেকে অনেক দূর যা বাগানের অবস্থান এবং পানি সরবরাহের সমস্যা উভয় দিক থেকেই  অসুবিধাজনক। তাহলে যে পাথরের ছাদটি পাওয়া গেছে সেটি আসলে কি! কিছু প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে এই ছাদটি আসলে কোনও উদ্যান নয় বরং প্রাসশনিক কাজকর্ম এবং স্টোররুম হিসাবে ব্যবহৃত হওয়া একটি জায়গা।  
আবার এমন কিছু মতবাদ প্রচলিত আছে যে ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগান আসলে ব্যাবিলনে ছিল না। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল ইরাকেরই প্রাচীন সাম্রাজ্য এসিরিয়ার নগর নিনেবেহ-তে। এবং নির্মাতা ছিলেন এসিরিয়ার রাজা। সিনেক্রেব টাইগ্রিস নদীর তীরে খ্রি:পূ: ৬৮১ সালের দিকে তিনি এটি সৃষ্টি করেছিলেন বলে জনশ্রতি আছে। তবে এই দাবীর স্বপক্ষে শক্ত কোন প্রমাণ দিতে পারেননি ইতিহাসবিদেরা । বাগানটির গঠন এবং অবস্থান নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও প্রাচীন ইরাকে যে একটি আধুনিক ছাদবাগান ছিল একথা  কেউই অস্বীকার করেনি।