যে জায়গাটাতে সবুজের সীমা সহজে বিলিন হয় না। যেখানে পাতার ফাঁকে ফাঁকে চোখ রেখে মায়ের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে দুষ্টু বানরের দল। আলো-আঁধারির শ্বাসমূলের এই বনে চার পায়ে হাঁটা বাঘের সঙ্গে প্রতিদিনই টেক্কা দেয় চিত্রা হরিণের ঝাঁক। সুন্দরবনের কোল ঘেষে রয়েছে বিভিন্ন নদ নদী তাই কুমির, হাঙর এর কথাও বাদ দেওয়া যাবে না। বিচিত্র শ্বাস মুলের এই জঙ্গলে লাল কাঁকড়ার ছুটা-ছুটি মুহূর্তেই মনের মধ্যে এক অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি করে। নানা রঙের পাখির কলকাকলি মুগ্ধ করে বনের মধ্যে ঘুড়তে যাওয়া মানুষের মন। আর মৌমাছির পিছু নিয়ে ছুটে যাওয়া মৌয়ালদের অক্লান্ত পরিশ্রম অবশ্যই প্রভাবিত করবে যে কোন অনুসন্ধানী মনকে।
সুন্দরবনের নাম সুন্দরবন কেন হল!
নাম হল একজন মানুষ বা একটি জায়গাকে দেওয়া বিশেষ পরিচিতি। তারপরও কিছু কিছু ব্যাতিক্রমী কারণে নির্ধারণ করা হয় এক একটি জায়গার নাম। সুন্দরবন নামের পেছনেও আছে কিছু জানা অজানা রহস্য। বাংলায় সুন্দরবন-এর আক্ষরিক অর্থ সুন্দর জঙ্গল বা সুন্দর বনভূমি। আর সুন্দরবনে অনেক সুন্দরী গাছ জন্মায় তাই এমন নামকরন করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। এছাড়া আরো একটি মতবাদ আছে যে সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে "সমুদ্র বন" বা "চন্দ্র-বান্ধে (বাঁধে)" (প্রাচীন আদিবাসী) থেকে। তবে সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয় যে সুন্দরী গাছ থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে।শত শত বছর আগের কথা। মুঘল আমলে চলছে। তখন স্থানীয় এক রাজা পুরো সুন্দরবনের ইজারা নেন। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে এই অঞ্চলের নদীপথে পর্তুগিজ জলদস্যুদের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। কিন্তু পর্তুগিজ জলদস্যুরা সবসময় সুন্দরবনের আশে পাশের মানুষদের উপর অত্যাচার চালাত। এই সময় পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচারে সুন্দরবনের অনেক সমৃদ্ধশালী জনপদ জনশূন্য হয়ে যায়। হাসনাবাদ থেকে এখানকার নদীপথে যেতে যেতে অনেক জায়গায় জীর্ণ বাড়িঘরের, ধ্বংসাবশেষ তার প্রমাণ বহন করে। ১৭ শতাব্দীর শুরুতে বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্য যশোর,খুলনা, বরিশালসহ ২৪ পরগনা জেলার অধিপতি ছিলেন। যশোররাজ প্রতাপাদিত্য পর্তুগিজ জলদস্যুদের সঙ্গে বারবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন। তিনি সাগর দ্বীপ, সরসুনা, জগদ্দল প্রভৃতি অঞ্চলে দুর্গ বানিয়ে এদের আটকাবার চেষ্টা করেন। সেনরাজা লক্ষ্মণসেন-এর সুন্দরবনলিপি থেকে জানা যায়, দ্বাদশ শতকের শেষে অযোধ্যা থেকে আগত পালবংশের 'মহারাজাধিরাজ' উপাধিধারী শ্রীমদ্ ডোম্মনপাল নামে এক সামন্ত রাজা উত্তর-পশ্চিম সুন্দরবনের 'পূর্বখাড়ি'তে (বর্তমান খাড়ি গ্রাম) স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন
অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ ছিল। বনের উপর মানুষের অধিক চাপ ক্রমান্বয়ে এর আয়তন সংকুচিত করেছে। ১৮২৮ সালে ব্রিটিশ সরকার সুন্দরবনের স্বত্ত্বাধীকার অর্জন করে। এল. টি হজেস ১৮২৯ সালে সুন্দরবনের প্রথম জরীপ কার্য পরিচালনা করেন। ১৮৩০ সালে ড্যাম্পিয়ার ও হজেস এই দু'জন সার্ভে অফিসার সুন্দরবনের ব-দ্বীপ অঞ্চলের উত্তর সীমা নির্ধারন করেন। এই রেখার নাম হয় ড্যাম্পিয়ার-হজেস রেখা। ১৮৭৮ সালে সমগ্র সুন্দরবন এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয় এবং ১৮৭৯ সালে সমগ্র সুন্দরবনের দায় দায়িত্ব বন বিভাগের উপর ন্যস্ত করা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে পড়ে। সুন্দরবনের একটি বড় অংশকে সংরক্ষিত বনভূমি হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয় ১৮৭৫-৭৬ সালে। পরবর্তী বছরের মধ্যেই বাকি অংশও সংরক্ষিত বনভূমির স্বীকৃতি পায়। পরবর্তীতে ১৮৭৯ সালে বন ব্যবস্থাপনার জন্য প্রশাসনিক একক হিসেবে বন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সদর দপ্তর ছিল খুলনায়।
0 Comments
Post a Comment