ডিপ্রেশন! শব্দটির সাথে সকলেই পরিচিত। বিশেষকরে যুবসমাজ। বর্তমানে যুবসমাজের সবচেয়ে কমন কিন্তু মারাত্মক সমস্যা ডিপ্রেশন বা হতাশা। সমাজের প্রতিটা মানুষই কোন না কোন কারনে হতাশায় বা বিষন্নতায় ভোগে। এদিক থেকে বিষন্নতা মানুষের খুব স্বাভাবিক একটি আচরণ কিন্তু এই হতাশা বা বিষণ্নতার মাত্রা বেড়ে গেলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষ অনেক বড় ধরনের সমস্যায় পরতে পারে এমনকি আত্মহত্যাও করে থাকে । মানুষের মন এমনইএক আজব জিনিস যেটা হুটহাট তার নিজের ডিরেকশন চেঞ্জ করে ফেলে তাই হতাশাও থাকবে কিন্তু আত্মবিশ্বাস হারানো যাবে না। খুব ছোট ছোট কারণেই অনেক সময় আমরা বিষন্ন হয়ে পড়ি আর এই বিষন্নতাই এক সময় নিতে পারে ভয়ংকর রুপ।
ডিপ্রেশন খুবই সাধারণ
কিন্তু মারাত্মক একধরণের মানসিক ব্যাধি যা আপনার অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা ও
কাজকর্মের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বর্তমানে
সারা বিশ্বেই ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা এক ভয়াবহ ব্যাধি বলে স্বীকৃত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন লোক এই
বিষন্নতা ব্যাধিতে ভুগছে যা তাদেরকে অক্ষমতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই বিরাট সংখ্যাটিকে শুধু সংখ্যা মনে করবেন না কারন এর মধ্যে
থাকতে পারেন আপনি, আপনার বন্ধু অথবা
ভাই কিংবা পরিচিত কেউ।
ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা কি বা এর অনুভুতি কেমন এটা অজানা থাকার কথা না। ডিপ্রেশন বা হতাশা হচ্ছে এমন একটা মানসিক অবস্থা যে অবস্থায় একজন মানুষের কোনো কিছুর প্রতি কোনো আগ্রহ থাকে না, ছন্নছাড়া একটা ভাব এবং নিজেকে অসহায় মনে হয়। বিষণ্নতাগ্রস্ত মানুষের কোনো কাজ করতে ভালো লাগে না খানিকটা উসকো খুশকো অগোছালো ভাব বিরাজ করে। খেতে ভালো লাগে না। বেড়াতে ভালো লাগে না, হাসতে ভাল লাগে না, গল্প করতে ভালো লাগে না। বস্তুত জীবনের কোনো অর্থই খুঁজে পাওয়া যায় না। কোনো কিছুতেই যেন কিছু যায় আসে না। এভাবে ক্রমান্বয়ে বিষণ্নতা বাড়তেই থাকে।
এতো বড় মারাত্মক একটা সমস্যা কিন্তু কেন হয় নির্দিষ্ট করে কারো পক্ষেই তা বলা সম্ভব না। বেশ কিছু সাধারন কারণ আছে যার জন্য এ রোগের উৎপত্তি হতে পারে। তবে নির্দিষ্ট করে বলা খুব কঠিন আসলে ডিপ্রেশনের উত্স কি। সম্মান প্রতিটা মানুষ আশা করে, কিন্ত সম্পূর্ণভাবে তা কত জন পেয়ে থাকে! সম্মান হারালে মানুষের অপমান বোধের উদয় হয়। এই অপমান বোধ অনেক সময় ডিপ্রেশনের কারন হতে পারে। প্রেম, ভালবাসা, বিয়ে বা যে কোনো সম্পর্ক যা ভেঙ্গে গেলে একাকীত্বতা সৃষ্টি হয়। বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব বা অন্যান্য কাছের মানুষদের সাথে সম্পর্কহীনতা বা মতবিরোধ থেকে বড় ধরনের একাকীত্বতা তৈরি হয় যা একটা সময় ডিপ্রেশনে পরিনত হয়। পরিবর্তন মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কিন্তু জীবন পদ্ধতিতে বড় ধরণের পরিবর্তন মানুষের জন্য শোকের কারন হয়ে উঠে অনেক সময়। সেই শোকও জন্ম দিতে পারে ডিপ্রেশনের। অনেক সময় হরমোনের পরিবর্তন হতে থাকলে ডিপ্রেশন আসে। বয়ঃসন্ধিকালে এই ধরনের অবস্থা লক্ষ করা যায়। এরকম হাজারো ছোট ছোট কারনে ডিপ্রেশনের মত মারাত্মক সমস্যার তৈরি হয়।
ডিপ্রেশনের কিছু বিশেষ লক্ষ্মণ
ডিপ্রেশনের সাথে যখন আপনি একটু গভীরভাবে
জড়িয়ে যাবেন তখন নিজের মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারবেন। তখন সেগুলো স্বাভাবিক
মনে হলেও একটা পর্যায়ে অসম্ভব খারাপ লাগার কারন হবে এগুলো। নিজেকে খুব
উদাসীন মনে হবে।
সকালে ভালো তো বিকেলে খারাপ।
আজ বেশ আনন্দে আছেন তো কাল
মানসিক যন্ত্রণা। এভাবেই চলতে থাকবে। আস্তে
আস্তে অভ্যাসে পরিনত হবে বাড়তে থাকবে বিরক্তি।
প্রতীকী ছবিঃ ডিপ্রেশনের লক্ষণ |
যে জীবনকে সৃষ্টি কর্তার দান মনে
করে উপভোগ করতেন মুহুর্তে সেই জীবনের প্রতি ঘৃণা বা উদাসীনতার জন্ম হবে। মনে হবে অনেক কিছু পাওয়ার ছিল, করার ছিল, কিন্তু হলো না। আমি ব্যার্থ। অতএব আমার এই জীবনটা অর্থহীন। মনে হবে এই অর্থহীন জীবনকেই
বয়ে নিয়ে যেতে হবে, কিন্তু আর কত দিন? এই ধরনের ভাবনা একসময় ভয়ংকর পরিনতির রুপ নেবে।
হঠাৎ মনে হবে এইতো
বেশ আছি, ভালো আছি কিন্তু সেটা খুব কম সময়ের
জন্য। পর মুহূর্তেই মনে হবে জীবনটাকে ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছি না। কখনো কখনো মনে হবে এই জীবন জীবন নয়।
আস্তে আস্তে নিজের উপর আস্থা হারিয়ে যাবে।
ভালো কথা গুলো শুনতেও খারাপ লাগবে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাবে। কেউ কিছু বললে , যদি ভালো বলে না
তো ঠিক আছে কিন্তু সামান্য মতের বাইরে গেলেই
তুমুল অশান্তি। টেম্পার লুস করে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলের উপক্রম হয়ে যায়। একসময় সেটা মানসিক ফোবিয়ায় পরিনত হয়ে যাবে।
কিছু অস্বাভাবিক ব্যবহার নিজের মধ্যে
অনায়াসে চলতে থাকবে যেমন - বারবার হাত-পা ধোয়া,
গোসল করা, ঘ্যান ঘ্যান করা অহেতুক চিন্তা ও উত্তেজনা, একটুতেই ঘাবড়ে যাওয়া, একটুতেই
ভেঙে পড়া, সবকিছুতেই বিরক্তির একটা ভাব
আপনার অজান্তেই আপনার মধ্যে গ্রো করবে।
পছন্দের গল্পের বইটি অসহ্য লাগবে, প্রিয় গানটি
গায়ে জ্বালা ধরাবে, প্রিয় মানুষের কথাগুলো সব থেকে তিক্ত লাগবে। অপ্রয়োজনেই অতিরিক্ত রিয়েক্ট
করে ফেলেবন, ভালো
সম্পর্কগুলো চোখের সামনে নষ্ট হতে থাকবে কিন্তু আপনার অনুভূতি আপনাকে জাগাবে না। গোসল
করা, কাপড় ধোয়া, খাবার ইচ্ছে সবকিছুই যেন
অতিরিক্ত প্রেশার এর মত মনে হবে।
রাতভর কখনো কম ঘুম আবার কখনো সব সময় শুয়ে থাকতে ভালো লাগবে। কোন
কাজেই মন বসবে ন। উৎসাহ হারিয়ে যাতে থাকবে।
আর কাজ করতে না পারার জন্য নিজের উপর রাগ হবে নিজেকে অপদার্থ মনে হবে।
ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে আসার উপায়
সমস্যা যেখানে আছে সমাধান ও আছে
তার। নিজের কিছু বেখেয়ালির জন্য যে সমস্যা
তা নিজের কিছু উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহনেই সমাধান করা সম্ভব। একটা সম্পূর্ণ দিনে ২৪ ঘন্টা
নিজেকে ব্যস্ত রাখুন যেকোন কাজে তবে অবশ্যই ভালো কাজ। উলটো পালটা চিন্তা করার সময় দিবেন না নিজেকে। সময়টাকে ভাগ করে নিন। রুটিন অনুযায়ী চলতে থাকুন দেখবেন বিভিন্ন কাজের
সাথে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন। আর সময়ের মুল্য
সম্পর্কে সচেতন হলেই সময়ের অবচয় করতে পারবেন না আপনি। তখন বাজে চিন্তার আর সময় পাবেন ন।
নিজেকে নিয়ে ভাবেন কখনো? নিজেকে নিয়ে ঘুরতে গেছেন কখনো? নিজেকে খুশি করার জন্য কিছু করেছেন কখনো? নিজেকে সময় দিন। নিজেকে নিয়ে ঘুরতে বের হন, কিছু সময় রিকসায় ঘুরুন দেখবেন এক অপূর্ব অনুভূতিতে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পারছেন আপনি। নিজেকে ট্রিট দিন, দোকান থেকে একটা চকলেট কিনে মুখে দিন আর উচু কোন জায়গা থেকে চকলেটের প্যাকেটটা উড়িয়ে দিন। কিছু সময়ের জন্য হলেও আপনার সব চিন্তা সব হতাশা থেকে মুক্তি পাবেন আপনি।
কিছু মানুষের সাথে নিজেকে মিলিয়ে
দিন যারা আপনার আপনজন বা বন্ধু। সময় কাটান তাদের সাথে। মেতে উঠুন হাসি ঠাট্টাই। কার্পন্য ভুলেগিয়ে মন খুলে হাসুন। কি ভাবছেন! বন্ধুরা হাসে না? সুযোগ পেলেই আপনার মন খারাপ নিয়ে উপহাস করে? এখানেও
আপনার বিচক্ষণতা কাজ করবে আপনার বন্ধু নির্বাচনে। যে আপনার বন্ধু কখনো সে কখনো আমনার
মন খারাপ থাকতেই দেবে না। নিজেকে জোকার
হিসেবে প্রমান করে হলেও আপনাকে হাসতে বাধ্য করবে।
সব সরিষার মধ্যে ভুত খুজবেন না, অর্থত্ সব কিছুতেই
নেতিবাচকতা দেখবেন না। সব কিছুর ইতিবাচকতা
নিয়ে চিন্তা করুন। একাজ আমাকে দিয়ে হবে না এটা না ভেবে শুধু ভাবেন এইকাজটা শুধু
আপনাকে দিয়েই সম্ভব, আপনি ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না। কখনো নিজেকে ব্যর্থ, অসহায় মনে করবেন না। সব অবস্থাতেই
সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস রাখবেন আর আত্মবিশ্বাস হারাবেন না। তাহলে হতাশা আপনার থেকে
বিদায় নিতে চাইবে।
আপনার পছন্দ অনুযায়ী কাজ করুন। যেটা করতে ইচ্ছা করে সেটাই করুন। মনের বিরোধীতা
করবেন না দয়াকরে। কঠিন কাজ হলেও সেটাই করুন যেটা করতে আপনার ইচ্ছা করছে। কে কি বলছে, কে কি ভাববে এটাকে প্রাধান্য
দিতে গেলে নিজের কাছে হেরে যাবেন। এই ধরনের কাজের মধ্যে থাকতে পারে, ঘুরতে যাওয়া, আড্ডা দেওয়া, বই
পড়া, সিনেমা দেখা, গান শোনা, রান্না করা বা যে কোন কাজ যা আপনার ভালো লাগে সেসব
কিছুই বিষণ্ণতা দূর করতে সাহায্য করতে আপনাকে সাহায্যে করবে।
শরীরের সাথে মনের একটা
আন্তঃসম্পর্ক বিদ্যমান। তাই মন ভালো রাখার জন্য শরীরকে ভালো রাখাও আপনার কর্তব্যের
মধ্যে পড়ে। শরীর ভালো রাখার জন্য ব্যায়াম করুন, ধ্যান করুন এতে সময়ের একটা বড় অংশ ব্যায় হবে সাথে সাথে আপনিও সুস্থ
শরীরের অধিকারী হবেন। সুস্থ শরীরের জন্য
ভালো ভালো খারাব খান। খাবারের লিস্টে কিছু
পরিবর্তন আনুন। হাভার্ড মেডিকাল কলেজের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, একটি
সুস্বাস্থ্যকর ডায়েট বিষণ্ণতা থেকে উত্তরণে বা মন ভাল রাখতে সাহায্য করে।
আপনি যে ধর্মের অনুসারী হন, নিজ নিজ সৃষ্টিকর্তার
কাছে প্রার্থনা করুন। প্রতিটা মানুষের আশা
পূর্ণতা পায় বিশ্বাসের মাধ্যমে। এই বিশ্বাস ধর্মের প্রতি, সৃষ্টিকর্তার প্রতি। সাধারণত
মানুষ যখন ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতায় ভোগে তখন তাদের কোন আশার বিঘ্ন ঘটে যার ফলে তারা ধীরে
ধীরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে শুরু করে। এমন সময় সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করুন, প্রার্থনা করুন এতে নিজের বিশ্বাস
শক্ত করার মাধ্যমে মানুষ শক্তি খুঁজে পাবেন।
ভালবাসার মানুষটির সাথে বিচ্ছেদ
হলে ভেঙ্গে পরবেন না। নিজের ভুলগুলো খুঁজে
বের করন, অপরাধবোধ হলে ক্ষমা চেয়ে নিন। আর যদি
সে নিজের থেকেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যেতে চাই তাহলে বুঝতে হবে বেটার অপশন আছে তার জন্য। আর সেটা
ভেবে থেমে না গিয়ে নিজেকে বেটার বানানোর প্রচেষ্টায় লেগে পরুন। দেখবেন আপনি তার থেকেও
বেটার অপশন পেয়ে যাবেন।
প্রকৃতিকে ভালুবাসুন। আপনাক
একাকীত্বতাকে সম্গ দিতে প্রকৃতি অনেক বড় ভুমিকা পালন করতে পারে। পড়ন্ত বিকালের সোনালী
রোদে বসে কখনো নদীর বয়ে যাওয়া উপভোগ করেছেন? ভেবেছেন কখনো নদীতে যে কাঠের টুকরো বা ভাঙ্গা ককশিট ভেষে চলেছে তার গন্তব্য কোথায়! ভাববেন অনেক ছোট ছোট প্রশ্নের
সমাধান পেয়ে যাবেন। সমুদ্র পাড়ে দাঁড়িয়ে ঢেউয়ের
অবাধ আছড়ে পরা দেখবেন নির্জনে শুনবেন তার গর্জন দেখবেন সব দুক্ষ, সব কষ্ট, সব হতাশা সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে
হারিয়ে যাচ্ছে।
ডিপ্রেশন মারাত্মক হলেও আমাদের তৎপরতায়
আমরা ডিপ্রেশনের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেতে পারি। ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা একটি মানসিক
ব্যাধি। বাহিরের যত চিকিৎসা বা পরামর্শই নেওয়া হোক নিজে থেকে সর্বাত্মক চেষ্টাই
বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে আসার অন্যতম উপায়।
0 Comments
Post a Comment