'থ্রি ইডিয়টস' মুভির শেষের দিকের কিছু দৃশ্যে বার বার প্রকৃতির প্রেমে পড়েছে অনেকে। পৃথিবীর অপার সৌন্দর্যের যে অংশকে স্বর্গের কাছাকাছি ভাবা হয়, সেটা লাদাখ। ধূসর, রুক্ষ পাহাড়ের মধ্যে সর্পিল রাস্তা। তা পেরিয়েই উপত্যকা, নীল হ্রদ। এই অপরুপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি লাদাখ। এখানকার পাহাড়ি শোভা, বরফ, রুক্ষ সৌন্দর্যের সঙ্গে আর কোনও কিছুর তুলনা হয় না। লাদাখের স্থানীয়দের কাছে এটি সৃষ্টি কর্তার অাশির্বাদ। লাদাখ বিভন্ন নামে পরিচিত। লাদাখ স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে ও নানা নামে পরিচিত হয়ে রয়েছে। যেমন, 'দ্য লাস্ট শাঙ্গরী লা', 'লিটল টিবেট', 'দ্য মুন ল্যান্ড' ও 'দ্য ব্রোকেন মুন', ইত্যাদি নামে একে ডাকেন স্থানীয় অধিবাসীরা। লাদাখের আয়তন বেশ কয়েকবার পরিবর্তন হয়েছে। কখনো কমেছে আবার কখনো বেড়েছে এর কারন হল লাদাখ এর মালিকানা বার বার পরিবর্তন হয়েছে। তাই লাদাখের আধুনিক ইতিহাসও বেশ বৈচিত্রপূর্ণ।
লাদাখ ছবিঃ উইকিমিডিয়া |
ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অন্তর্গত উত্তরে কুনলুন পর্বতশ্রেণী এবং দক্ষিণে হিমালয় দ্বারা বেষ্টিত এই ভু-স্বর্গ। এই এলাকার অধিবাসীরা ইন্দো-আর্য এবং তিব্বতী বংশোদ্ভুত বলে কথিত । লাদাখ কাশ্মীরের সবচেয়ে জনবিরল এলাকার মধ্যে একটি।। ঐতিহাসিককাল ধরে বালটিস্তান উপত্যকা, সিন্ধু নদ উপত্যকা, জাংস্কার, লাহুল ও স্পিটি, রুদোক ও গুজ সহ আকসাই চিন এবং নুব্রা উপত্যকা নিয়ে লাদাখ সমৃদ্ধ ছিল। কালের বিবর্তনে বর্তমানে লাদাখ শুধুমাত্র জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের লেহ জেলা ও কার্গিল জেলা নিয়ে গঠিত। লাদাখের অধিবাসীরা অধিকাংশ তিব্বতী হওয়ায় লাদাখ তিব্বতী সংস্কৃতি দ্বারা প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত হয়। এই অঞ্চলকে তাই ক্ষুদ্র তিব্বত ও বলা হয়ে থাকে।
লাদাখে বৌদ্ধ ও মুসলিম জনবহুল একটি অঞ্চহল। এখানে বৌদ্ধ ও মুসলিম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা প্রায় সমান। পূর্বাঞ্চলে বৌদ্ধরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং উত্তর ও পশ্চিমে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। বৌদ্ধদের নিদর্শন বেশি থাকায় পর্যাটকরা পূর্বাঞ্চলের দিকেই বেশি ঝোঁকে। এখানে যে নিদর্শন গুলো রয়েছে সেগুলো সরাসরি তিব্বতি বৌদ্ধ সংস্কৃতির সাথে সর্ম্পকিত। লাদাখের খুব অল্প সংখক মানুষ জম্মু ও কাশ্মীরে বসবাস করেন। পর্যটক এখানকার মানুষের জন্য অাশির্বাদ। ১৯৭৪ সাল থেকে এই অঞ্চলে প্রথম বিদেশি পর্যটকের আগমন শুরু হয়, ধীরে ধীরে তাঁদের সংখ্যা বাড়তে থাকে আর এখন তো দেশি পর্যটকের চেয়ে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যাই বেশি। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস এবং গুম্ফা এখানে অাসা বিদেশি পর্যটকদের বিশেষ অাকর্ষণ
লাদাখের আধুনিক ইতিহাস
ইতিহাস সব কিছুর অতীতকে অামাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। লাদাখ এমনই একটি জায়গা যার ইতিহাস অনন্য ও বিচিত্র। বেশ কয়েকবার লাদাখের স্বাধীনতার রদবদল হয়েছে। ১৯৪৭ সাল। ভারত নব্য স্বাধীন রাষ্ট্ট হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ভারত স্বাধীন হলে কাশ্মীরের ডোগরা শাসক হরি সিং অন্তর্ভুক্তি চুক্তিতে সই করে লাদাখ সহ সমস্ত কাশ্মীর রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন । এই সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কাশ্মীর উপত্যকা, স্কার্দু এবং জাংস্কারের পাদুম দখল করে লেহ অভিমুখে যাত্রা করে। তখন ভারত বাঁধা দেয় এবং পরিস্থিতি বেশ ঘোলাটে হতে থাকে। একপর্যায়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ভারত-পাকিস্তান এই যুদ্ধের মাধ্যমে লাদাখ পাকিস্তানী দখলমুক্ত হয়। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়। এসময়ে লাদাখ ও বালটিস্তান রাজনৈতিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পাকিস্তানের পর শুরু হয় চীনের সাথে। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে চীন জিনজিয়াং ও নুব্রা উপত্যকার মধ্যে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে চীন ভারতের দাবিকৃত এলাকা আকসাই চিনের মধ্য দিয়ে জিনজিয়াং ও তিব্বতের মধ্যে সড়ক ও পাকিস্তানের সঙ্গে কারাকোরাম মহাসড়ক নির্মাণ করলে সীমান্তে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধের মাধ্যমে লাদাখের আকসাই চিন ও পার্শ্ববর্তী এলাকা চীন নিজের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। লাদাখ হাতছাড়া হয় ভারতের। সামরিক কৌশলগত কারণে ভারত শ্রীনগর থেকে লেহ পর্যন্ত ১ডি নং জাতীয় সড়ক তৈরী করেন। ১৯৭১ ও ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান লাদাখের পশ্চিমাংশের কার্গিল অঞ্চল নিজেদের দখলে নেওয়ার চেষ্টা করলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের মাধ্যমে পুনরায় তা ভারতের অধিকারে আসে। এভাবে লাদাখের মালিকানার রদবদল হতে থাকে।
লাদাখের রাজনৈতিক সীমানা |
এরমধ্যে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সঙ্গে লাদাখের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক সম্পর্ক বহু টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে গেছে। যার ফলে দুই অঞ্চলই বেশ ক্ষতির মুখে পরেছে। ১৯৭০ এর দশক থেকে এই অঞ্চলের মানুষেরা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মর্যাদার দাবি জানিয়ে এসেছে। এরপর শুরু হয় আন্ত দেশীয় কোন্দল। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে লাদাখে বসবাসকারী বৌদ্ধ ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে হিংসাত্মক দাঙ্গা সৃষ্টি হয়। এতে বৌদ্ধরা মুসলিম প্রধান জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের মুসলমানদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলে। তারা লাদাখে বসবাসকারী মুসলিম ব্যবসায়ীদের সাথে ব্যবসা বন্ধ করে দেয়। শুরু হয় আর্থিক ক্ষতির। ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে লাদাখ স্বায়ত্ত্বশাসিত পার্বত্য উন্নয়ন পরিষদ, লেহ তৈরী হয়। এর ফলে ক্ষোভ বহুলাংশে প্রশমিত হলেও বর্তমানে জাতীয় স্তরে গুরুত্বলাভের আশায় লাদাখের প্রভাবশালী বৌদ্ধরা ভারতীয় জনতা পার্টিকে সমর্থন করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মর্যাদার দাবি জানাচ্ছে বার বার।
0 Comments
Post a Comment