ইতিহাস বা গল্প যা সবসময় রহস্যের চাদরে মোড়া থাকে। আর তা যদি হয় কোন প্রচলিত হাস্যরসাত্মক, ব্যাঙ্গাত্মক চরিত্র তাহলে তো সেই রহস্য আরোও ঘোলাটে হয়ে উঠে।  "কে সে, পরিচয় কি তার, হাসির রাজা, রসিক রাজা, জ্ঞানের রাজা গোপাল ভাঁড়"  তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন একজন ব্যক্তি, গোপাল ভাঁড় নামেই যার পরিচিতি, যার মাথায় টাকপড়া, পেট মোটা বেটে। এই চরিত্রটির সাথে সবাই পরিচিত। যুগ যুগ ধরে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত তাঁর গল্প শুনে হাসেনি এমন গোমড়ামুখো বাঙালির দেখা পাওয়া যাবেনা।  কেননা, এখন পর্যন্ত গোপাল ভাঁড়ই রসপ্রিয় বাঙালির মৌখিক ঐতিহ্যের যথাযোগ্য প্রতিনিধি। ছোট বেলায় গোপাল ভাড়ের গল্প শুনে ঘুমাতে যাওয়া অভাস্যে পরিনত হয়ে যায় বাঙালি ছেলে মেয়েদের।  কিন্তু গোপাল ভাঁড় কি শুধুই একটা চরিত্র? নাকি বাস্তবে এরকম কেউ ছিলো? এই বিষয়টি নিয়ে ধোয়াশার অন্ত নেই।


গোপাল ভাঁড় : বাস্তবিক রক্ত মাংসের একজন ব্যাক্তি নাকি কাল্পনিক চরিত্র।
গোপাল ভাড়ের মুর্তি
 

গোপাল ভাঁড়ের রহস্য জানার জন্য আগে যে নামটি আসবে তিনি হলেন জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র। জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়ের সময় থেকে আমাদের এই সময়ের দূরত্ব ১৭০০ থেকে ২০০০অর্থাৎ ৩০০ বছরের। কিন্তু মাত্র ৩০০ বছরের আগেকার মানুষ গোপাল ভাঁড়কে নিয়ে এত ধোঁয়াশা কেন, যেখানে তাঁর সমসাময়িক কৃষ্ণচন্দ্র, ভারতচন্দ্র সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্যের অভাব নেই! বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে এই বিখ্যাত চরিত্রকে নিয়ে।

গোপাল ভাঁড় : বাস্তবিক রক্ত মাংসের একজন ব্যাক্তি নাকি কাল্পনিক চরিত্র।
কৃষ্ণ নগর 

গোপাল ভাঁড় ছিলেন মধ্যযুগের নদিয়া, অধুনা কুষ্টিয়া অঞ্চলের একজন প্রখ্যাত রম্য গল্পকার, ভাঁড় ও মনোরঞ্জনকারী। তাঁর আসল নাম গোপাল চন্দ্র প্রামাণিক যিনি অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদিয়া জেলার প্রখ্যাত রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় নিযুক্ত ছিলেন।  রাজা তাঁকে তাঁর সভাসদদের মধ্যকার নবরত্নদের একজন হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। গোপাল ছিলেন খুব বুদ্ধিমান এবং তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি ছিল অত্যন্ত প্রখর। তিনি হাস্যরস সৃষ্টির মাধ্যমে রাজাকে সর্বদা খুশি রাখতেন এবং তাৎক্ষণিক যে-কোনো ব্যাপারে বাস্তব ঘটনাশ্রিত গল্পের মাধ্যমে গভীর শিক্ষণীয় বিষয় তুলে ধরতেন। কিন্তু গোপাল ভাঁড়ের কোনো ঐতিহাসিক স্বীকৃতি নেই। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্ব সম্পর্কে ইতিহাসে প্রচুর তথ্য পাওয়া গেলেও তার কোথাও উল্লেখ নেই যে, তাঁর সভায় গোপাল নামে একজন ভাঁড় ছিলেন। আবার কেউ কেউ এব্যাপারটিকে আরও বেশি নির্দিষ্ট করে উপস্থাপনের জন্য বলেছেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের দেহরক্ষক হিসেবে শঙ্কর তরঙ্গ নামে এক ব্যক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁর সাহস, উপস্থিত বুদ্ধি ও জ্ঞানের জন্য রাজা তাঁকে বিশেষ মর্যাদা দিতেন। হয়ত তিনিই পরবর্তীকালে গোপাল ভাঁড় হিসেবে কল্পিত হয়েছেন। 
আবার অনেকের মতে গোপালের জন্ম কত বঙ্গাব্দে তা কোথাও উল্লেখ নেই। অনেকে মনে করেন গোপাল নামে কেউ আদৌ ছিলেন না। তবে কোনো না কোনো বিদূষক রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রিয়পাত্র হয়েছিলেন। সেরকম গোপাল নামে কোনো নাপিত বংশীয় কোনো ব্যক্তি থাকতে পারেন বলে অনেকের বিশ্বাস। গোপালের জন্ম বা জন্মস্থান কোথায় সেবিষয়ে কোথাও সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায় নি। এমনকি কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা হিসেবে তার অবস্থানের বিষয়ে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। নগেন্দ্রনাথ দাস বিরচিত নবদ্বীপ কাহিনি দাবি করে, গোপালের বাবার নাম জানা গেলেও তার মা ও স্ত্রী সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। 

গোপাল ভাঁড় : বাস্তবিক রক্ত মাংসের একজন ব্যাক্তি নাকি কাল্পনিক চরিত্র।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র 


গোপালের ছবি কেউ কখনো দেখেনি। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পঞ্চরত্নসভার রাজকবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর মহারাজ, তার রাজত্ব ও সভাসদদের নিয়ে যে কাব্যগ্রন্থ লিখে গেছেন সেখানেও তিনি গোপাল ভাঁড়ের কোনো নাম উল্লেখ করেননি। এমনকি কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির মহাফেজখানায় গোপালের অস্তিত্বের প্রমাণস্বরূপ কোনো দলিল দস্তাবেজ নেই। তবে শুধুমাত্র কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে গোপালের ছবি বলে একটি অয়েল পেইন্টিং ঝোলানো রয়েছে, যেখানে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রও রয়েছেন। সেটি নিয়েও ঐতিহাসিক মহলে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তার সময়ের কোনো বই-পুস্তক ইত্যাদিতেও গোপাল ভাঁড়ের কোনো নাম পাওয়া যায় না, এমনকি তার নিজের লেখাও কোনো বই নেই।
এ পর্যায়ে এসে একটি গল্প মনে পড়ে গেল - কৃষ্ণচন্দ্র গোপালকে একবার বললেন, ‘আমি সত্য-মিথ্যার মধ্যে দূরত্ব অনুমান করতে পারছি না। এ ব্যাপারে তুমি আমাকে একটু সাহায্য করলে ভালো হয়।’ গোপাল বললেন, ‘এ আর এমন কী কঠিন সমস্যা, মহারাজ! চোখ আর কানের মধ্যে যতটা দূরত্ব, সত্য ও মিথ্যার মধ্যেও ততটা।’গোপালের কথার অর্থ বুঝলেন না কৃষ্ণচন্দ্র। বললেন, ‘বুঝিয়ে বলো। আমি তোমার কথার অর্থ বুঝতে পারলাম না।’ এবার গোপাল বললেন, ‘মহারাজ, যা শুনবেন, তা যদি চাক্ষুষ প্রমাণ করতে পারেন, তবে তা-ই হলো সত্যি। আর কানে শুনলেন, চোখে দেখলেন না, এটা কখনো সত্যি নয়। সে জন্যই সত্য-মিথ্যার সঙ্গে চোখ-কানের সম্পর্ক খুবই গভীর এবং চোখ-কানের মধ্যে দূরত্ব যতটা, সত্য-মিথ্যারও দূরত্ব ততটা।’

গোপাল ভাঁড় : বাস্তবিক রক্ত মাংসের একজন ব্যাক্তি নাকি কাল্পনিক চরিত্র।
গোপাল ভাড়ের কল্পিত রূপ।
ছবিঃ ইন্টরনেট


সম্প্রতি এক বিশ্লেষণে জানা গেছে,  হুগলির খানাকুল থেকে গোপাল ভাঁড়কে নিজের রাজসভায় বিদূষক করে এনেছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। আর এমনই অসংখ্য তথ্য রহস্যের জাল বুনে বাংলা সাহিত্যে রয়ে গেছেন গোপাল ভাঁড় চরিত্র। সেই গোপাল ভাঁড়কে নিয়েই কলকাতা বইমেলায় গবেষণাধর্মী বই প্রকাশ করেছিলেন সাংবাদিক সুজিত রায়। বইটির নাম ছিল  'গোপাল ভাঁড়ের সন্ধানে'। আর সেই বইয়ের সুত্রে জানা যায়, কলকাতার একটি বাড়িতে পাঁচ পুরুষ ধরে বাস করছেন গোপাল ভাঁড়ের বংশধররা৷ এই বাড়িরই তিন সদস্য মলয়কুমার দাস, বিষ্ণুমাধব দাস ও ছ' বছরের শৌভিক দাস এর অস্তিত্ব ও পাওয়া যায় ৷ অপর দিকে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের বংশধর সৌমিশচন্দ্র রায় ও বলেছেন গোপাল ভাঁড় কোনও কল্পনিক চরিত্র নন, তিনি রক্ত মাংসের একজন মানুষ ছিলেন ৷ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র আর গোপালের খুব ভাল সম্পর্ক ছিল ৷ গোপালের বিচক্ষনাতার জন্য রাজা অনেক কাজই গোপাল ভাঁড়ের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে 
গোপাল ভাঁড় আসলে ছিলেন গোপালচন্দ্র নাই। কথিত আছে মুর্শিদাবাদে আনন্দরাম নাই নামে একজন পরমতান্ত্রিক সাধক বাস করতেন। তিনি জাতিতে নাপিত ছিলেন। তার বড় ছেলের নাম কল্যাণ আর কনিষ্ঠজন ছিল গোপাল।  মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র গোপালকে  রাজভাণ্ডারি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে গোপালচন্দ্র ভাণ্ডারি হাস্যার্ণব উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। ওই ভাণ্ডারি শব্দটিরই অপভ্রংশ থেকে ভাঁড় হয়ে গেছে। সেদিক থেকে গোপালের পদবী ছিলো ‘নাই’। ‘নাই’ শব্দের অর্থ নাপিত। তাহলে কি গোপাল  নাপিত বংশজাত ছিল?  ঐতিহাসিক ও ভাষাবিদ সুকুমার সেন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘গোপাল ভাঁড় সম্পর্কে আধুনিক বাঙালির কৌতুহল থাকার ফলে বাস্তব অথবা কল্পিত ব্যক্তিটির সম্পর্কে যে জনশ্রুতি জাতীয় ঐতিহ্য গজিয়ে উঠেছে ও উঠছে তার বীজ হচ্ছে ভাঁড় নামের অংশটি। গোপাল ভাঁড়ের ভাঁড়টুকু সংস্কৃত শব্দ ভাণ্ডারের ‘ভাণ্ড’-জাত মনে করে অনেক গোপালের জাতি নির্ণয় করেছেন। নাপিতের জাতি ব্যবসায় ভাঁড়-ক্ষুর নিয়ে। সুতরাং গোপাল ভাঁড় নাপিত।
গোপালচন্দ্রের অসামান্য বুদ্ধিগুণে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র অনেকবার নবাব সরকারের কাছে ঘোর বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছিলেন। তার বাক্য প্রয়োগে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। ভগবত ও পুরাণে তার যথেষ্ট দখল ছিল, রামায়ণ-মহাভারত আদ্যপান্ত ছিল তার মুখস্থ। এমনকি রাজনীতি ও সমাজনীতিতেও তিনি ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। মহারাজের কৃপায় কৃষ্ণনগরের ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে তাকে পরিগণনা করা হতো। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রই লোকমুখে তার এসব গুনের কথা শুনে তাকে খুঁজে বের করে কৃষ্ণনগরে নিয়ে আসেন। জানা যায়, গোপাল বাল্যকাল থেকেই ছিলেন সুদর্শন, সুচতুর। বাক্য প্রয়োগে ছিল তার বিশেষ পারদর্শিতা। তো তার এ বাকচাতুর্য শক্তিই তাকে সমাজে আলাদাভাবে একটি স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করতে সমর্থ হয়। উপরন্তু তিনি ছিলেন ধর্মপরায়ণ এবং চরিত্রবান। ফলে মহারাজা ও মহারানী তাকে সন্তানের মতোই স্নেহ করতেন বলে গবেষকদের দাবি। গোপালের একটি ছেলে ও একটি মেয়ে ছিল। মেয়ের নাম রাঁধারানী, তার দুই পুত্র রমেশ ও উমেশ। কিন্তু তার পুত্রের খুব অল্প বয়সেই মৃত্যু হয়। 
তবে কাল্পনিক বা বাস্তব যা-ই হোক, গোপাল ভাঁড় বাংলা লোকসাহিত্য-এর একজন বিশেষ ব্যক্তিত্ব। যার ঐতিহাসিক স্বীকৃতি কোন স্বীকৃতি না থাকলেও বাঙালী মনে এক জীবন্ত অস্তিত্ব।