গল্পের কোন নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই। গল্পের কোন যথা উপযোগী  শুরু  বা শেষ ও নেই। হঠাৎ করেই শুরু আবার হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যেতে পারে। মাতাল হাওয়ার কোন নির্দিষ্ট শুরু থাকতে নেই। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র  কে হবে সেটাও বুঝে উঠতে পারতেছি নাহ।

আচ্ছা! ক্রিকেটের ইতিহাসে খেলা শেষে দর্শকদের   মাতাল হাওয়ার মতো মাতাল করে রেখে গেছে  এমন  বা কতজন  ক্রিকেটার আছে। স্যার ভিভ রিচার্ডস, এবি ডি ভিলিয়ার্স,  ক্রিস গেইল, মাইকেল বেভান, আব্দুল রাজ্জাক। এরা! হ্যা, এরাইতো। 

হঠাৎ করে মনে হচ্ছে এদের সাথে  শাহীদ আফ্রিদি নামটা যাই। আগেই বলেছি এ গল্পের কোন নির্দিষ্ট চরিত্র নাই। আবার সবাইকে নিয়ে গল্প শুরু করাও সম্ভব না। তাই আফ্রিদিকে দিয়েই শুরু করা যাক। 

গল্পের নাম মাতাল হাওয়া!
ছবিঃ উইকিমিডিয়া 


গল্পের চরিত্র পাওয়া গেলেও  এ গল্পের কোন নির্দিষ্ট শুরু থাকবে না , হয়তো শেষও। কেনো যেনো মনে হচ্ছে তবু শহীদ আফ্রিদির আন্তজার্তিক ক্যারিয়ার এর শুরুটা বলা উচিত। কেনো বলা উচিত  সেটা অনেকেরই অজানা নয়। তবু লিখতে হবে যারা জানে না তাদের জন্য।  ১৯৯৬ সালের কথা। কেনিয়ার নাইরোবিতে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ওয়ানডে খেলতে নেমে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৪০ বলে ১০২ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলেছিলেন আফ্রিদি।  আসলে ৩৭ বলে করলেন ওয়ানডে ইতিহাসের দ্রুততম সেঞ্চুরি। ছক্কাই হাঁকিয়েছিলেন ১১টি, সঙ্গে ৬টি চারের মার।  ভাস-মুরালিদের নিয়ে গড়া বিশ্বসেরা বোলিং লাইনআপ এর সামনে ১৬ বছর বয়সী তরুণের কীর্তিতে সাড়া পড়ে গিয়েছিল ক্রিকেট বিশ্বে। তাছাড়া সে সময়ে কেউ ভাবতেই পারতো না, এত কম বল খেলেও শতক হাকানো যাই।

মাতাল হাওয়া কখনো একই সূত্র ধরে গল্প শোনায় নাহ। বিভিন্ন দিকে মোড় নেয়। এ গল্প ও নির্দিষ্ট  কোন গল্পের ওপর ভিত্তি করে নয়। বরং অনেক গুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গল্পের সমষ্টি।


২০০৫ সালের কথা। ভারতের মাটিতে সিরিজ খেলতে পাকিস্তানের সফর। সেবার ২-২ এ সমতা থাকায় সিরিজের শেষ ম্যাচ হয়ে যাই আনঅফিসিয়াল ফাইনাল। প্রথমে ব্যাট করে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ভারতের সংগ্রহ দাড়ায় ৫ উইকেটে ২৪৯। কানপুরে  ৪৫ বলে সেঞ্চুরি করে তার ধ্বংসাত্মক ব্যাটিংয়ের জন্য ‘বুম বুম’ খ্যাতি পেয়ে যান আফ্রিদি। ১০ চার ও ৯ ছক্কায় করেন ১০২ রান। করেন ওয়ানডেতে দ্বিতীয় দ্রুততম শতক। সাথে সাথে পাকিস্তান জিতে নেয় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে তাদের মাটিতেই দ্বিপাক্ষিক সিরিজটি।


আরো বছর দুয়েক পেরিয়ে গেছে। ২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের আসর বসে দক্ষিণ আফ্রিকায়। কি অনবদ্যই না খেললেন পাকিস্তানের সাহেবজাদা! ৯১ রানের সাথে বল ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন ৭ ম্যাচে ১২ উইকেট। যদিও ফাইনালে  চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের কাছে  হেরে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি তবু জিতেছিলেন বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার। টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসরে ও খেললেন অনবদ্য। ইংল্যান্ডে বসা সে আসরে সেমিফাইনাল আর ফাইনালে হলেন ম্যান অব দ্যা ম্যাচ। পাকিস্তানকে করলেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। সেবার টুর্নামেন্টজুড়ে ব্যাট হাতে করলেন ১৭৬ রান আর বল ঘুরিয়ে নিলেন ১১ উইকেট। সেবার দিলশান ব্যাট হাতে অবিশ্বাস্য না খেললে হয়তো আবারো তার হাতেই উঠতো টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার।


গল্পের নাম মাতাল হাওয়া!
ছবিঃ উইকিমিডিয়া 


ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে একজন লেগ স্পিনার হিসেবেই দলে ডাকা হতো তাকে। তবে বল হাতে যে খুব ধারাবাহিক হয়ে উঠেছিলেন তেমনটা নয় আবার ব্যাটিংয়েও একই কথা। তবে আফ্রিদি একা হাতেই প্রতিপক্ষকে গুড়িয়ে দিতে পারতেন কখনো ব্যাটিংয়ে  আবার কখনো বোলিংয়ে। ২০০৯ সালে এপ্রিলে, দুবাইয়ে হলো তেমনই এক ম্যাচ। সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ১০ ওভার বল করে ৩৮ রান খরচায় শিকার করেছেন ৬ উইকেট। ব্র্যাড হাডিন, ওয়াটসন, অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস, নাথান ব্রাকেন এবং স্টুয়ার্ড ক্লার্কদের মতো খেলোয়াড়দের সেদিন নাকানি-চুবানি খেতে হয়েছে তার লেগ স্পিনের কাছে। ব্যাট হাতেও কম যাননি তিনি।খেললেন  ১৫ বলে ২৪ রানের এক কুইকফায়ার ইনিংস। পাকিস্তান ম্যাচ জিতে নেয় ৪ উইকেটে।

এরপরে কোন গল্প করা যাই , ২০১১ বিশ্বকাপের গল্প। সেবার আফ্রিদির নেতৃত্বে পাকিস্তান দলটি যে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলবে, সিংহভাগ  ক্রিকেটপ্রেমীই ভাবতে পারেনি। নেতৃত্বের সাথে সাহেবজাদা খেলেছিলেনও অনবদ্য। ২১ উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন বিশ্বকাপসেরা উইকেটশিকারী। নাহ! থাক। এ গল্প আজ আর না। পরে কোন একদিন করা যাবে।

আচ্ছা! ২০১১ সালের পাকিস্তান শ্রীলংকার  দ্বিপাক্ষিক  সিরিজের চতুর্থ ওয়ানডের কথা মনে আছে। সেবার ৯৭ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে পাকিস্তানের নাস্তানাবুদ অবস্থা। হাল ধরলেন আফ্রিদি। ব্যাট হাতে খেললেন ৭৫ রানের ইনিংস। পাকিস্তান পেয়ে গেলো ২০০ রানের পুঁজি। কে জানতো তখনো আফ্রিদি ম্যাজিক বাকি। ৩ উইকেট হারিয়ে ১৫৫ রানে ব্যাট করছে শ্রীলংকার সাঙ্গাকারা-ম্যাথিউস জুটি। আফ্রিদি জাদুতে মাত্র ১৯ রান যোগ করতে শ্রীলংকা অলআউট।বল হাতে নিলেন ৫ উইকেট। পাকিস্তান জিতলো ২৬ রানে।


২০১৪ সালের এশিয়া কাপের কথা। মিরপুরে ফ্লাডলাইটের আলোয় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে ২৪৬ রানের বিরুদ্ধে ব্যাটিংয়ে পাকিস্তান। বিনা উইকেটে ৭১ রান সংগ্রহের পরে অশ্বিন জাদুতে খেই হারিয়ে ফেলে পাকিস্তান। কিন্তু পরিস্থিতিটা সামলে জয়ের বন্দরে দলকে নিয়ে যান আফ্রিদি। জয়ের জন্য ৫০তম ওভারের শেষ চার বলে  পাকিস্তানের প্রয়োজন ছিল ৯ রান আর ভারতের ছিল ১ উইকেট। সমীকরণটা মোটেও সহজ ছিলনা পাকিস্তানের জন্য। কেননা বল হাতে ছিলেন পুরো ম্যাচে পাকিস্তানকে ভুগানো অশ্বিন।  অবশ্য পাকিস্তানের জন্য স্বস্তি হয়ে ক্রিজে ছিলেন আগের ম্যাচেই ২৪ বলে ৫৯ করে ম্যাচ জেতানো আফ্রিদি। যেহেতু তাকে মাতাল হাওয়ার সাথে তুলনা করেছি, সেহেতু ক্রিকেটপ্রেমীদের মাতাল করার ক্ষমতা তার আছে।  পর পর দুটি  ছয় হাঁকিয়ে দলকে জয়ের স্বাদ এনে দেন এই অলরাউন্ডার। সাথেসাথে  চিরচেনা উদযাপনে দেখা যাই  আফ্রিদিকে। 

আরকিছু লেখা উচিত! নাহ! থাক। বলেছিতো এ গল্পের কোন নির্দিষ্ট শেষ নেই। কিন্তু মিরপুরের সে দুই ছক্কার পরে ক্রিকেটপ্রেমীরা মাতাল হাওয়ার প্রেমে মাতাল বনে গেছেন।