জীবন যাপন বড়ই অদ্ভুতধরনের । বাউন্ডুলে আর ছন্নছাড়া স্বভাবের। সে মেসে থাকলেও মাঝে মাঝে রাস্তায় ও পার্কে রাত কাটায়। তার প্রধান কাজ খালি পায়ে হেঁটে, রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো। বেকারত্বই তার পেশা। তবে সে মানুষের কল্যাণের জন্য অনেক কাজ করে থাকে। আর মাঝেমাঝে আধ্যাত্মিক শক্তির মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে দেখা যায়। লোভ, লালসা, ঈর্ষা, ভয়ের কোনকিছুই তার মধ্যে নেই। এরূপ আচরণ অনেক মানুষকে তাকে মহাপুরুষ ভাবতে প্রভাবিত করে।
কল্পিত হিমু |
মনে করতে পেরেছেন , কার কথা বলতে চাচ্ছি। বলছিলাম স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত উপন্যাস " হিমুসমগ্র" এর হিমু চরিত্রটির কথা। লেখক ১৯৯০ সালে প্রথম "ময়ূরাক্ষী" নামে উপন্যাসের মধ্য দিয়ে পাঠকদের মাঝে হিমু চরিত্রটিকে উপস্থিত করেছেন। লেখকের এ চরিত্রটি পাঠকের মনে এতটাই জায়গা করে নিয়েছিল যে শহরের রাস্তায় অনেক যুবককে হলুদ পান্জাবী পরে খালি পায়ে হাটতে দেখা গেছে।
আচ্ছা, রুপার কথা মনে আছে। হিমুর বান্ধবী রুপা। সেই মেয়েটি যে কিনা হিমুকে পছন্দ করতো, হয়তোবা ভালোবাসতো ও। মাঝে মাঝে নীল শাড়ি পরে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতো হিমুর জন্য। কিন্তু হিমু কখনোই আসতো না। মাঝেমাঝে চিঠিও লিখতো কিন্তু হিমু কালেভদ্রে ও চিঠির উত্তর দিত না।
কখনো কি মনে হয়েছে লেখকের রুপা চরিত্রটিকে উপন্যাসে নিয়ে আসার পেছনে কারন কি? পাঠকেরা তো কৌতূহল প্রকৃতির হয়ে থাকে। মনে হয়েছে কখনো?ময়ূরাক্ষী, এবং হিমু, হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম, হলুদ হিমু নীল রুপা উপন্যাসে লেখক উপস্থিত করেছেন রুপা চরিত্রটিকে।
কল্পিত রূপা |
হুমায়ূন আহমেদ নিজেও ছিলেন অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ।জীবন থেকে কোন চরিত্রকেই হারাতে চাননি কখনোই। কিন্তু তিনি হারিয়েছেন।লেখক হিসাবে তার সার্থকতা এখানেই।যখনই হারাতে বসেছেন , তখনই কোনো না কোনো উপন্যাসের চরিত্র হিসাবে প্রান দিয়েছেন।
১৯৬৯ সালের কথা। দেশেজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা। হুমায়ূন আহমেদের দিন কাটে মহসীন হলের একটা সিঙ্গেল রুমে। লেখক তখন ঢাবির দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। লেখকের এক বন্ধু কোন এক তরুনীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। বন্ধুটি এসে লেখককে বলে , "চিঠি লিখে দেওয়ার দায়িত্ব তোমার"। মেয়েটির একখানা চিঠি পড়ে লেখক পরম মমতায় বসে যায় উত্তর লিখতে।দুজনের কেউ কাউকেই চিনে না অথচ দিনের পর দিন লেখক তার চিঠির উত্তর লিখে যাচ্ছে।
এই তরুনীর নাম ছিল রুপা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে হুমায়ূন আহমেদের বন্ধু মেয়েটিকে বিয়ে করেনি। সে বিয়ে করেছিল তার এক পরিচিতা আত্মীয়কে। বিয়ে করে শ্বশুরের পয়সায় পাড়ি জমিয়েছিল ইংল্যান্ডে। বিয়ের অনুষ্ঠানে লেখক গিয়েছিলেন কুমিল্লা।বন্ধুপত্নীকে দেখে কিছুটা ধাক্কা খেয়েছিলেন । অতি স্বাস্থ্যবতী কন্যা সারাক্ষণই হাসছে। পরে অবশ্য খেয়াল করেন কন্যার দাঁত মুখের বাইরে, ঠোঁট দিয়েও সে দাঁত ঢেকে রাখতে পারছে না।
হিমু ও রূপার স্রষ্টা |
রুপাকে লেখক হয়তো সরাসরি দেখেনি। তবে তার ছবি দেখেছিলেন। পটে আঁকা ছবি। দেখতে কতই না মিষ্টি ছিল মেয়েটা। রুপা হারিয়ে গিয়েছিল। রুপাকে আর কখনো চিঠি লেখাও হয় নাই তার। আগেই বলেছি , লেখক হওয়ার সার্থকতা হলো হারিয়ে যাওয়া চরিত্রটিকে তার লেখায় প্রাণ দিতে পারবেন। তিনি হিমুকে নিয়ে লেখা প্রায় প্রতিটা উপন্যাসেই হিমুর বান্ধবী হিসেবে প্রাণ দিলেন রুপা চরিত্রটিকে। লেখকের "মাতাল হাওয়া " উপন্যাসে রুপা চরিত্রটি নিয়ে এসবই লিখেছেন। কিন্তু অপূর্ণতা রাখলেন উপন্যাসেও। হিমু কখনোই মুখ ফুটে বলেনি, "রুপা তোমায় আমি ভালোবাসি"।
0 Comments
Post a Comment