ইতিহাস অতীতের সাক্ষী আর বর্তমানের হলফনাম। ইতিহাসে কিংবা গল্পে বেশ বৈচিত্র্যময় লোককথা আর প্রবাদের সম্ভার আছে প্রতিটি সাহিত্যেই।
একবার কিছু মানুষ এলাকার এক জ্ঞানী মানুষের কাছে কিছু শিখতে চাইল। উপস্থিত মানুষদের কাছে জ্ঞানী মানুষটি জানতে চাইল, আমি তোমাদের আজ কি শেখাবো তোমরা কি জানো?
প্রতিকী নাসিরুদ্দিন ছবিঃ উইকিপিডিয়া |
উপস্থিত জনতা বলল না। তখন জ্ঞানী মানুষটি বলল কিছু জানোনা যেহেতু আর জেনে লাভ নাই সবাই চলে যাও। পরের দিন সবাই আবার জ্ঞানী মানুষটির বাড়িতে এলো। যথারীতি আজো জ্ঞানী মানুষটি একি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল। আজ আমি তোমাদেরকে কি বলব তোমরা কি জানো? এবার আর তারা ফিরে যেতে চায় না। তারা সবাই বলল হ্যা জানি। তখন জ্ঞানী বলল জানো যেহেতু তাহলে আমার থেকে আর কি জানবে সবাই ফিরে যাও। পরেরদিন তারা আবারও এলো কিন্তু এবার আর কিছু না শিখে ফিরে যেতে চায় না। যথারীতি জ্ঞানী আবারও সেই একি কথা জিজ্ঞেস করল। আজ আমি তোমাদেরকে কি বলব তোমরা কি জানো? এবার লোকগুলো দুই দলে ভাগ হয়ে গেল, এক দল বলল জানি তো আরেকদল বলল আমরা জানি না। এবারও জ্ঞানী বলল যারা জান তারা যারা জানেনা তদেরকে জানিয়ে দাও।
কি নিশ্চয় এতক্ষণে বুঝে গেছেন কার কথা বলছি? হ্যা হোজ্জা নাসিরুদ্দিনের কথা বলছি। গল্পে বর্ণিত এই ব্যাক্তি মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জা যার পূর্ণ নাম নাসির উদ্দীন মাহমুদ আল খায়ী। যিনি মধ্য এশিয়ায় পরিচিত এক হাস্যরসিক ব্যাক্তিত্ব হিসেবে। মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্পগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষকে নির্মল আনন্দ জুগিয়ে আসছে। লোককথায় তার চরিত্র এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, চারদিক থেকে সে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তাইতো গোপাল ভাড়ের গল্পটাও তার নামে দিব্যি চালিয়ে দেওয়া যায়, আবার তার গল্পও গুলিয়ে যায় গোপাল ভাড়ের সাথে।
মোল্লা নাসিরউদ্দিনের জন্ম ও পরিচিতি
একটি দেশের সীমানা বা সমৃদ্ধ কোন অঞ্চলের দাবি করতে দেখা যায় অনেক দেশকেই। কিন্তু একজন মানুষ যাকে বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিক হিসেবে দাবি করা হয়েছে। নিকট ও মধ্য প্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশই নাসিরুদ্দিনকে তাদের দেশের নাগরিক বলে দাবী করেছে। এর মধ্যে রয়েছে আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক এবং উজবেকিস্তান। আসলে তার জন্ম হয়েছিল ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুরস্কের খোর্তো গ্রামে। নাসিরুদ্দিন খুব জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। ধর্ম বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল অত্যান্ত প্রখর। নাসিরউদ্দিন হোজ্জা একজন বেঁটে মানুষ ছিলেন। মাথায় পাগড়ি আর গায়ে জোব্বা পরে একটা গাধার ওপর চড়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন।
গাধার পিঠে হোজ্জা প্রতিকী ছবি। ছবিঃ উইকিপিডিয়া |
হোজ্জাকে নিয়ে লোকসাহিত্যে অসংখ্য গল্প চালু আছে। কিছু কিছু গল্পে তাকে খুব বুদ্ধিমান একজন মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে আবার কিছু কিছু গল্পে তার আচরণ একেবারেই বোকার মতো। ফলে নাসিরুদ্দিন মহাবুদ্ধিমান নাকি মহাবোকা ছিলেন তা নিয়ে জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। তবে তিনি সারাবিশ্বে পরিচিতি পেয়েছেন তার রসবোধের কারণে।
তুরস্কের আকসেইর শহরেই প্রতিবছর জুলাইয়ের ৫ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত ‘আন্তর্জাতিক নাসির উদ্দীন হোজ্জা উৎসব’ পালন করা হয়ে থাকে। তার কথাবার্তা আমাদের যেমন হাসায়, তেমনি ভাবায়ও বটে। তার গল্পগুলো বেশিরভাগ তুরস্কের বাইরে মূলত মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে অধিক প্রচলিত। এর বাইরেও ইউরোপের গ্রীস, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া আর জার্মানিতেও বেশ প্রচলিত আছে নাসিরউদ্দিনের গল্প । চীনেও তার কিংবদন্তীর বেশ প্রচলন আছে। মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জা অনেক জায়গাতে নাসিরুদ্দিন এফেন্দি নামেও পরিচিত। তার জীবনের প্রতিটা ঘটনার সাথে কোনো না কোনো রসিকতা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তাঁর রসিকতার হাত থেকে তাঁর গিন্নিও বাদ পড়েনি। একবার তাঁর গিন্নি রান্নাঘরে রান্না করছিলেন এমন সময় তিনি ঘরে কিছু একটা পড়ার শব্দ শুনতে পান। তিনি চেঁচিয়ে হোজ্জার কাছে জানতে চাইলেন কি পড়ার শব্দ হলো। হোজ্জা চেঁচিয়ে উত্তর দিলেন "আমার পাঞ্জাবিটা পড়ে গেছে এটা তারই শব্দ", গিন্নি বলল "আমাকে বোকা পেয়েছো? পাঞ্জাবি পড়লে এত শব্দ হয়"? পাঞ্জাবির ভিতরে আমিও ছিলাম স্বভাব সুলভ উত্তর দিলেন হোজ্জা সাহেব। এ থেকেই বোঝা যায় তাঁর রসবোধের চর্চা থেকে তাঁর স্ত্রীও বাদ যায়নি।
নাসিরুদ্দিন হোজ্জার গল্পকথা
হোজ্জার সব গল্প এক ধরনের না। তার একটি গল্পে রয়েছে এক এক ধরনের ভিন্নতা। কখনও তিনি চালাকি করে অন্যকে বোকা বানাচ্ছেন, আবার কখনও বিভিন্ন গল্পে সাধারণ প্রশ্নের উত্তরে অদ্ভুত জবাব দিয়ে প্রতিপক্ষকে নিরস্ত্র করে। বিশ্বব্যাপী হাস্যরসাত্মক লোকসাহিত্যে হোজ্জা সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র হোলেও হোজ্জার গল্পগুলোকে একেবারে সাদামাটা হাসির গল্পও বলা ভুল হবে। কারণ সাধারণ হাসির গল্পের চেয়ে এর স্বাদ আরেকটু বেশি। তাছাড়া গল্পগুলো হাসির হলেও, কিন্তু কখনো কখনো তা পাঠকের চিন্তাকে নাড়া দেয়। হোজ্জার অধিকাংশ গল্পতে তাকে সব সময় স্পষ্টবাদী হিসেবে দেখা গেছে। এদিক থেকে দেখতে গেলে হোজ্জার গল্পগুলোকে 'স্যাটায়ার' বলাও চলে।
হোজ্জার বিখ্যাত কিছু গল্প
হোজ্জা নাসিরুদ্দিনের মুর্তি ছবিঃ উইকিমিডিয়া |
হোজ্জার অসংখ্য গল্প রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল 'ফুঁ দিলে গরম হয়, ঠাণ্ডাও হয় ', 'হোজ্জার অঙ্ক কষা', 'কেউ কেউ জানি, কেউ কেউ জানি না', 'আলখাল্লা’র পরিবর্তে জোব্বা', 'প্রস্তুত প্রণালী তো আমার কাছে'। হোজ্জার বুদ্ধিদীপ্ততা এবং রসিকতার প্রমান তার গল্পেই পাওয়া যায়। নাসিরুদ্দিন হোজ্জা তখন কাজী। বিচার আচার করেন। একদিন বিচারে বসেছেন। বাদি মামলার আসামির সম্পর্কে যেসব অভিযোগ করছেন হোজ্জা তা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। বাদীর বলা শেষ হয়ে মাথা ঝাকিয়ে বললেন, হুমম, তোমার কথাই ঠিক। এ কথা শুনে আসামি বলে উঠল, হুজুর, আমার কিছু কথা ছিল। হোজ্জা বললেন, ঠিকাছে, বলো তুমি কী বলতে চাও? আসামির বক্তব্যও মনোযোগ দিয়ে শোনার পর হোজ্জা বললেন,হুমম, তোমার কথাও ঠিক। হোজ্জার স্ত্রী পর্দার আড়ালে এতক্ষণ সব কথা শুনছিলেন। বিরক্ত হয়ে স্বামীকে তিনি বললেন, দুইজনের কথাই ঠিক হয় কিভাবে? হয় আসামির কথা ঠিক না হয় বাদির কথা ঠিক। হোজ্জা স্ত্রীর দিকে ফিরে হাসি দিয়ে বললেন, হুমম, তোমার কথাই ঠিক।
মোল্লা নাসিরউদ্দিন হোজ্জার জীবনাবসান
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে (১২৮৪) মোল্লা নাসিরউদ্দিন হোজ্জা মারা যান। মারা গিয়েও এই রসাত্মক গল্পের মধ্যেই বেঁচে আছেন মোল্লা নাসিরুদ্দীন হোজ্জা। তুরস্কের আকশেহিতে মোল্লা নাসিরুদ্দিন সম্মানে যে ‘আন্তর্জাতিক নাসিরুদ্দীন হোজ্জা উৎসব’ হয়ে থাকে সেখানে সারাবিশ্ব থেকে হোজ্জা অনুরাগীরা সেখানে পাড়ি জমান । এই আকশেহির শহরেই নাসিরুদ্দিন হোজ্জার সমাধি অবস্থিত। এই উৎসবের এক বিশেষ আকর্ষন থাকে যেখানে একজন প্রতীকী নাসিরুদ্দিন আকশেহিরে ঘুরে বেড়ান। হোজ্জার বিখ্যাত সব কাজকর্মের আলোচনা, ছবি আঁকা ইত্যাদি মাধ্যমে ওই সময়ে তাকে স্মরণ করা হয়। এসময়ে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে কার্টুনিস্ট আর গল্প লেখকরা পাড়ি জমান হোজ্জার এই শহর আকশেহিতে।
0 Comments
Post a Comment