মৃত্যুতেই মানুষ অস্তিত্ব হারায় না।  মরে গিয়ে ও বেচে থাকে লাক্ষ্য কটি মানুষের হৃদয়ে।  তেমন একজন মানুষ ফকির লালন শাহ। যিনি একাধারে ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক ও দার্শনিক। তাঁর গানে খুজে পাওয়া যায় এক বিরল মানব দর্শনের। লালন শাহ, লালন ফকির বা লালন সাঁই নামেও পরিচিত ছিলেন, আর  মৃত্যুর ১২৯ বছর পর আজও বেঁচে আছেন তাঁর গানের মাঝে।  উনিশ শতকে বাউল গানে লালন শাহ বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে, তাইতো তাকে "বাউল-সম্রাট" বা "বাউল গুরু" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে ।

লালন শাহ; এক বাউল সম্রাটের গল্প

জন্ম ও ছেলেবেলা 

লালন শাহ কোথায় জন্ম গ্রহন করেছেলেন তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কারণ সঠিক কোন লিখিত তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে কিছু নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া গেছে লালন ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশের) ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু উপজেলার হারিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এব্যাপারেও দ্বিমত রয়েছে কারণ অনেকে মনে করেন লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার চাপড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত ভাড়ারা গ্রামে জন্মেছিলেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন লালনের জন্ম যশোর জেলার ফুলবাড়ি গ্রামে। জন্ম সুত্রে তিনি হিন্দু ছিলেন এমন উল্লেখ আছে। তার জন্ম হয়েছিল সম্ভ্রান্ত এক হিন্দু কায়স্থ পরিবারে। বাবা মাধব কর ও মা পদ্মাবতীর একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি। বেশ অল্প বয়সেই পিতার মৃত্যু হয় তাই একমাত্র ছেলে হওয়ায় সংসারের চাপ এসে পড়ে তার উপর।  সংসার সামলাতে গিয়ে তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ তিনি পাননি। 


বাউল জীবনের সূচনা

লালন শাহ যৌবনকালে একবার বন্ধুদের সাথে তীর্থভ্রমণে বের হয়েছিলেন।  সেখানে পথিমধ্যে বসন্ত নামক রোগে আক্রান্ত হন তিনি।  ভাগ্যের নির্মমতায় সঙ্গীরা তাঁকে পরিত্যাগ করে চলে যায়। রাস্তায় পড়ে থাকেন লালান ফকির। এমতাবস্থায় সিরাজ সাঁই নামে একজন মুসলমান ফকির তাঁকে মুমূর্ষু অবস্থায় বাড়িতে নিয়ে যান।  সেখানেই সেবা-শুশ্রূষা দ্বারা সুস্থ করে তোলেন লালন কে। পরে লালন তাঁর নিকট বাউলধর্মে দীক্ষিত হন এবং ছেউড়িয়াতে একটি  আখড়া নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে তিনি স্ত্রী ও শিষ্যসহ এখানেই বসবাস করেন। লালন কোনো জাতিভেদ মানতেন না। লালন শাহ হিন্দু কি মুসলমান, এ কথা  স্থির বলিতে অক্ষম সব গবেষক । বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় লালনের জীবদ্দশায় তাকে কোনো ধরনের ধর্মীয় রীতি-নীতি পালন করতে দেখা যায়নি। তবে সাধনার সময় তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের শাস্ত্র সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভ করেন। তাঁর রচিত গানে সেই জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। তাই তিনি গেয়েছেন: ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/ লালন কয় জাতির কি রূপ দেখলাম না এ নজরে।’ এরকম অনেক গানের রচয়িতা ছিলেন লালান ফকির। 
 

লালন শাহ; এক বাউল সম্রাটের গল্প


লালনের জনপ্রিয়তা 

লালন শাহ শুধু গানে নয়, আরো অন্যান্য মাধ্যমেও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে লালনকে। নাটক,  উপন্যাস,  ছোটগল্প,  চলচ্চিত্র,  কবিতা সব জায়গাতেই রচিত হয়েছে লালন কে নিয়ে দুই এক লাইন। তার জীবনীর নির্ভরযোগ্য তথ্য ও লালন-দর্শনের মূল কথা নিয়ে সাইমন জাকারিয়া রচনা করেছেন “উত্তরলালনচরিত” শীর্ষক নাটক। রণজিৎ কুমার লালন সম্পর্কে সেনবাউল রাজারাম, নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন। পরেশ ভট্টাচার্য রচনা করেন বাউল রাজার প্রেম নামে একটি উপন্যাস। ভারতের বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লালনের জীবনী নিয়ে রচনা করেন মনের মানুষ উপন্যাস। লালন ফকিরকে নিয়ে কয়েকটি চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ হাসান ইমাম পরিচালনা করেছেন লালন ফকির চলচ্চিত্রটি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে একই নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ম. হামিদ ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে পরিচালনা করেন তথ্যচিত্র "দ্যাখে কয়জনা"। মার্কিন কবি এলেন গিন্সবার্গ লালনের দর্শনে প্রভাবিত হন এবং তার রচনাবলীতেও লালনের রচনাশৈলীর নিপুন ব্যবহার দেখা যায়।

লালন শাহ; এক বাউল সম্রাটের গল্প

জীবনাবসান 

১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর লালন ১১৬ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেউড়িয়াতে নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর প্রায় একমাস পূর্ব থেকে তিনি পেটের সমস্যা ও হাত পায়ের গ্রন্থির সমস্যায় ভুগেছেন।  মৃত্যুর আগেও তিনি গানে গানে তার শিষ্যদের বলেছে চলিলাম,  আমি চলিলাম।  তাঁর নির্দেশ বা ইচ্ছা না থাকায় তাঁর মৃত্যুর পর হিন্দু বা মুসলমান কোনো ধরনের ধর্মীয় রীতি নীতিই পালন করা হয় নি তার লাশ নিয়ে। তাঁরই উপদেশ অনুসারে ছেউড়িয়ায় তাঁর আখড়ার মধ্যে একটি ঘরের ভিতর তাঁকে সমাধি করে রাখা হয়।