ইতিহাস পড়ুয়া সকল শিক্ষার্থী প্রথম চন্দ্রগুপ্তের নামের সাথে পরিচিত। আসলে প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। চন্দ্রগুপ্তকে ভারতের মৌর্য রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের দিকের কথা, তখন প্রাচীন ভারতে সাম্রাজ্যের বিকাশ ঘটে। মৌর্য সাম্রাজ্য ভারতের ইতিহাসে প্রথম সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে মৌর্য সাম্রাজ্য ছিল ভারতের কৌম সমাজের পরিবর্তিত রুপ। মৌর্য সম্রাটরা বহু বিভক্ত ভারতকে একত্রিত করে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। বিশ্বব্যাপী যা তাদের খ্যাতির পরিচয় বহন করে।
চন্দ্রগুপ্তের পূর্বপুরুষ ও কৈশোর সম্বন্ধে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়ন। বিভিন্ন ধ্রুপদী সংস্কৃত, গ্রিক ও লাতিন সাহিত্য ও ঐতিহাসিক রচনা থেকে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে যেখানে চন্দ্রগুপ্তের জীবনকালের ৭০০ বছর পরে রচিত সংস্কৃত নাটক মুদ্রারাক্ষসে তাকে নন্দন্বয় বা নন্দের বংশধর হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। নন্দরাজ্যের রাণীর এক দাসী ছিল, যার নাম মুরা। একদা নন্দরাজ দাসী মুরার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে ধর্ষণ করে তার গর্ভসঞ্চার করেন। লোকলজ্জার ভয়ে নন্দরাজ মুরা ও তার সন্তানকে অস্বীকার করেন। এতে ক্ষিপ্ত চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যের সহায়তায় নন্দবংশ উৎখাত করে মৌর্য বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। বৌদ্ধ গ্রন্থ মহাবংশে চন্দ্রগুপ্তকে মোরিয় নামক একটি ক্ষত্রিয় গোষ্ঠীর সন্তান বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য গ্রিকদের নিকট সান্দ্রোকোত্তোস বা আন্দ্রাকোত্তাস নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে ২৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্বেচ্ছা অবসর নেওয়া পর্য্যন্ত রাজত্ব করেন ও তার পরে তার পুত্র বিন্দুসার সিংহাসনে আরোহণ করেন। চন্দ্রগুপ্ত ক্ষমতায় আসার পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশ বেশ কয়েকটি মহাজনপদে বিভক্ত ছিল এবং সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমতলভূমি নন্দ রাজবংশ দ্বারা শাসিত হত। সেই সময় চন্দ্রগুপ্ত তার রাজত্বের শেষ পর্য্যন্ত তামিল ও কলিঙ্গ অঞ্চল ব্যতিরেকে ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পূর্বে বাংলা থেকে পশ্চিমে আফগানিস্তান ও বেলুচিস্তান, উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে দাক্ষিণাত্য মালভূমি পর্যন্ত তার শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। ভারতের ইতিহাসে চন্দ্রগুপ্তের পূর্বে এত বড় সাম্রাজ্য নির্মান করতে পারে নি।
চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যে তার প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন চাণক্য। চন্দ্রগুপ্ত ও তার প্রধান পরামর্শদাতা চাণক্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন করেন। চাণক্য রচিত অর্থশাস্ত্রের ওপর নির্ভর করে চন্দ্রগুপ্ত একটী শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসন গড়ে তোলেন। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য ও কৃষির উন্নতির সাথে সাথে এই সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার ফলস্বরূপ একটি শক্রিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। চাণক্য নামক তক্ষশিলার এক কূটনৈতিক ব্রাহ্মণের নিকট শিক্ষালাভ করেন ও দুইজনে মিলে নন্দ সম্রাট ধননন্দকে সিংহাসনচ্যুত করার পরিকল্পনা করেন। বিশাখদত্ত রচিত মুদ্রারাক্ষস নাটকে ও জৈন গ্রন্থ পরিশিষ্টপার্বণ গ্রন্থে হিমালয়ের একটি পার্বত্য রাজ্যের রাজা পর্বতেশ্বর বা পর্বতকের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের মিত্রতার কথা উল্লিখিত রয়েছে।
এই রাজা এবং পুরুষোত্তম একই ব্যক্তি বলে অনেক ঐতিহাসিক মত দিয়েছেন।
বিশাখদত্ত রচিত মুদ্রারাক্ষস নামক সংস্কৃত নাটকে নন্দ সাম্রাজ্য পতনে চাণক্যের ভূমিকা বর্ণিত রয়েছে। এই গ্রন্থানুসারে, হিমালয়ের একটি পার্বত্য রাজ্যের অধীশ্বর পর্বতেশ্বরের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা চাণক্য কূটনৈতিক মিত্রতা স্থাপন করে নন্দ সাম্রাজ্যকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। কিন্তু এই সময়, পর্বতেশ্বরকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হলে মলয়কেতু তার স্থানে সিংহাসনে আরোহণ করেন। নন্দ সাম্রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী রাক্ষসের সঙ্গে মিলিত ভাবে মলয়কেতু নন্দ সাম্রাজ্যের অধিকৃত এলাকা দাবি করেন। শেষ নন্দ সম্রাট ধননন্দের হত্যার প্রতিশোধ নিতে মলয়কেতুর সহায়তায় রাক্ষস রাজধানী আক্রমণ করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এই পরিস্থিতিতে চাণক্য যেন তেন প্রকারে রাক্ষসকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করাতে চেয়েছিলেন। রাক্ষসের প্রতীক মুদ্রাটি হস্তগত করে চাণক্য চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যকে উদ্দেশ্য করে একটি নকল চিঠি প্রস্তুত করেন। এই চিঠিতে রাক্ষসের মুদ্রার ছাপ দিয়ে লেখা হয় যে তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের শিবিরে যোগ দিতে ইচ্ছুক। চাণক্য প্রথমেই মলয়কেতুর নিকট এই চিঠির বিষয়ে বার্তা পাঠালে তাতে বিশ্বাস করে মলয়কেতু রাক্ষসের সঙ্গত্যাগ করেন। এই ভাবে চাণক্য রাক্ষসকে তার সঙ্গীদের থেকে দূরে সরিয়ে দেন। পরবর্তী কৌশল হিসেবে তিনি রাক্ষসের বন্ধু চন্দনদাসের মৃত্যুদণ্ড দিলে রাক্ষস তাকে বাঁচাতে, আত্মসমর্পণে ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনে বাধ্য হন।
একটা পর্যায়ে চন্দ্রগুপ্ত দক্ষিণ ভারতের দিকে অগ্রসর হন। তিনি বিন্ধ্য পর্বত পেরিয়ে দাক্ষিণাত্য মালভূমির সিংহভাগ দখল করতে সক্ষম হন। এর ফলে কলিঙ্গ ও দাক্ষিণাত্যের অল্পকিছু অংশ বাদে সমগ্র ভারত মৌর্য্য সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়। সঙ্গম সাহিত্যের বিখ্যাত তামিল কবি মমুলনার মৌর্য্য সেনাবাহিনী দ্বারা দাক্ষিণাত্য আক্রমণের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। জৈন আচার্য্য ভদ্রবাহুর নিকট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভ করেন ও পরবর্তীকালে বিয়াল্লিশ বছর বয়সে সিংহাসন ত্যাগ করে জৈন ধর্ম গ্রহণ করে তার সাথে দাক্ষিণাত্য যাত্রা করেন। জৈন প্রবাদানুসারে, চন্দ্রগুপ্ত শ্রবণবেলগোলায় জৈন আচার সল্লেখনা বা স্বেচ্ছা-উপবাস করে দেহত্যাগ করেন।
0 Comments
Post a Comment