বেলের কাঁটা  চেনেন? অবশ্য চেনে না এমন লোকই হয়ত হাতে গোনা কয়েকজন। গ্রামাঞ্চলে  কথিত আছে, 
"বেলের  কাঁটা ফুটলে পায়ে, জীবন যাবে  অকাতরে"।
বেলের কাঁটা আপনার শরীরের ভোগান্তির সাথে সাথে মনের মাঝে রেখে যাবে  এক ভয়ানক স্মৃতির ছাপ। ক্রিকেটও তেমনই। অনেক উজ্জ্বল প্রতিভার অঙ্কুরে বিনষ্ট হওয়া কিংবা তেমন করে নিজেকে মেলে ধরতে না পারা আপনার মনে দাগ কেটে যাবে।

শাহরিয়ার নাফিস: সমর্থক মনে বেল কাঁটা


বিনোদ কাম্বলি! মোহাম্মদ আসিফ! স্টুয়ার্ট  ম্যাকগিল! উমর আকমল!  ক্রিকেটীয়  প্রতিভার বিচারে নিজেদের মেলে ধরতে না পারা "ওয়েস্ট" এর তালিকায় অনেক  উচ্চ কন্ঠেই উচ্চারিত হবে এদের নাম। 

এতোক্ষণে হয়ত মনে মনে বুলি আওড়াচ্ছেন,  বাংলাদেশ ক্রিকেটের  "ওয়েস্ট" তাহলে কারা?  উত্তর ও হয়তো পেয়ে গেছেন! একে একে মনে পড়বে  - তালহা জুবায়ের, মার্শাল আইয়ুব, অলক কাপালি,  নাজমুল হোসেন, মোহম্মদ আশরাফুলদের নাম। আনকোরা ধাচের হলে এনামুল বিজয় আর তাসকিনদের নামও বলে ফেলতে পারেন।



আরেকটু ভালোভাবে চিন্তা করলে হয়তো বলবেন শাহরিয়ার নাফিসের কথা। কিন্তু কেনো বলবেন? ২৪  টেস্টে  করেছেন মাত্র ১২৬৭ রান!  গড় ২৬ এর একটু বেশী।  ওয়ানডে  খেলেছেন ৭৫ টি। ২২০১ রানের ছোট্ট ক্যারিয়ারে গড় ৩১ এর আশেপাশে। একেবারেই সাদামাটা পরিসংখ্যান। বাংলাদেশ ক্রিকেটের নয়াভক্ত হলে হয়তো আপনি ভাবতে পারেন, এ আবার কেমন করে  "ওয়েস্ট"  হতে পারে? কেননা পরিসংখ্যান আপনার অবুঝ মনকে  খুশি করতে পারেনি বলেই সে "ওয়েস্ট"।

এমন করে বললে আপনি কখনোই মেনে নিতে চাইবেন না। টাইম ট্রাভেল করে আপনাকে ফিরে যেতে হবে  আরো  বছর পনের আগে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটে তার আগমন ২০০৫ এ। সেসময় বাংলাদেশ ক্রিকেট মানেই আকাশ ঘনকালো মেঘে ঢাকা। সাকিব-তামিমদের আগমন তখনো হয় নাই। মুসফিক এসেছেন মাত্র। তবে আজকের দিনে যে মুশফিককে দর্শক চেনে,  সেসময়ের সাথে রয়েছে আকাশ-পাতাল তফাত। শাহরিয়ার নাফিসের  বংলাদেশ ক্রিকেটে আগমন হয়েছিল সূর্যের মতো। যে সূর্য  দুর্ভেদ্য ঘনকালো মেঘ ভেদ করে এনে দিয়েছিল নতুন দিনের সকাল।



১.
ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার সাথে তৃতীয় দেশ হিসাবে  বাংলাদেশকে নিয়ে  শুরু হয় ন্যাটওয়েস্ট ত্রিদেশীয় সিরিজ- ২০০৫। সে সিরিজেই ডাক পড়ে তরুন নাফিসের। নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে অভিষিক্ত হন নাফিস। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র  ১০ রানের মাথায় আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরেন। তবে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ম্যাচেই গ্লেন ম্যাকগ্রা, ব্রেট লি, জেসন গিলেস্পি, শেন ওয়াটসন, ব্রাাড হগ ও অ্যান্ড্রু সায়মন্ডসদের নিয়ে গড়া অস্ট্রেলিয়ান বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে নিজেকে মেলে ধরেন। খেলেন  ৪৭ রানের ইনিংস। সিরিজের গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে এই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই ক্যারিয়ারের প্রথম হাফসেঞ্চুরি তুলে নেন। ৭৫ রানের ইনিংসটি খেলেন নড়বড়ে ব্যাটিং লাইন আপের চাপ সামলে। সে ম্যাচে মাত্র ১৯ রানেই ফিরে গিয়েছিল টপ অর্ডারের সেরা তিন ব্যাটসম্যান। যার ফলে বাংলাদেশের ক্রিকেটে স্মরণীয় আবির্ভাব  ঘটে সে সময়ের তরুন তুর্কি শাহরিয়ার নাফীসের।

২.
প্রথমবারের মতো ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সফরে আসে অস্ট্রেলিয়া।বছর দুয়েক আগে অবশ্য টেস্ট খেলতে বাংলাদেশ দল  অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েছিল। কিন্তু দুই ম্যাচেই বাংলাদেশকে ইনিংস ব্যবধানে হারিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। তবে বাংলাদেশ সফরে তার কোন ছাপ পড়েনি। পূর্ণশক্তির দল নিয়েই বাংলাদেশ সফরে আসে অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বসেরা লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্নের পাশাপাশি দ্বিতীয় স্পিনার হিসাবে দলে ছিলেন স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল। পেস অ্যাটাকেও দেখা মেলে তাদের পরিণত সকল অস্ত্ররই। 



ফতুল্লাতে সিরিজের প্রথম টেস্টে টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। শাহরিয়ার নাফিস এবং জাভেদ ওমরে শুরু হয় উদ্বোধনি জুটি। শুরু থেকেই দুই ওপেনার অজি বোলারদের উপর চড়াও হন। ওয়ানডে মেজাজে খেলে উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে তুলে নেন ৫১ রান।

অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের জন্য সারপ্রাইজ প্যাকেজ  হিসাবে আসে  বাংলাদেশের দ্বিতীয় উইকেটের জুটি। হাবিবুল বাশারকে সঙ্গে করে গড়ে তোলেন  ১৮৭ রানের পার্টনারশিপ ।  শাহরিয়ার নাফিস করেন ১৮৯ বলে ১৩৮ রানের এক আনফরগেটেবল ইনিংস। শেন ওয়ার্নের টানা দুই বলে দুই চার মেরে সেঞ্চুরি  পূর্ন করেন। আগের বছরে এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে সর্বোচ্চ ৯৬ উইকেট নেওয়া ওয়ার্নকে  এক সাদামাটা বোলারে পরিনত করেন নাফিস।

ফতুল্লায় সেবারই হয়তো অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট জয়ের স্বপ্ন পূর্ণ হতে পারতো। কিন্তু চতুর্থ ইনিংসে পন্টিং  দৃঢ়তায়  জয় পাই অস্ট্রেলিয়া।


৩.
২০০৬ সালে শাহরিয়ার নাফিস ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। নিজের ক্যারিয়ারের হাইলাইটস ও বলতে পারেন এ বছরটিকে। ২৮টি একদিনের ম্যাচে ৪১.৩২ ব্যাটিং গড়ে  করেন ১০৩৩ রান করেছিলেন। প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে করেন ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি। রান সংগ্রহের তালিকাতে বিশ্বে ছিলেন ৬ এ।  বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ও একমাত্র হিসাবে এক পঞ্জিকাবর্ষে করেন  সহস্রাধিক রান। ২০০৬ সালের অনবদ্য নৈপুণ্যের কারণে সে বছর আইসিসির সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের সংক্ষিপ্ত তালিকাতে এসেছিলেন। এছাড়া বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড থেকে বর্ষসেরা ক্রিকেটার এবং বর্ষসেরা ব্যাটসম্যানের অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন। সেবারে গ্রামীণফোন-প্রথম আলো বর্ষসেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্ব নির্বাচিত হন নাফিস।

২০০৭ সাল যেনো নাফিসের ক্যারিয়ারের কাল হয়ে দাড়ায়।  এক কথায় ওয়ানডে  বিশ্বকাপকেই দায়ী করা যাই। আগের বছর যেখানে রানের ফুলঝুরি ছোটান, সেখানে  বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচ মাঠে নেমে, করেন মাত্র ৩১ রান।এরপর থেকেই মুলত ভরসা হারাতে থাকেন। জায়গা হতে থাকে সাইড বেঞ্চে।

দেশের প্রথম টি-টুয়েন্টিতে নেতৃত্ব দেন শাহরিয়ার। অথচ সে সময়ে সর্বকনিষ্ঠ হিসাবে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া নাফিসকে বিশ্বকাপ টি-টুয়েন্টির প্রাথমিক স্কোয়াডেই রাখা  হলো না। এরপর আর কখনোই নিয়মিত খেলা হয়নি জাতীয় দলে। দুই ম্যাচ খেলেছেন তো চার ম্যাচ বসে রয়েছেন ।

২০০৮ সালে আয়ারল্যান্ড সিরিজে করলেন টানা তিন ম্যাচে তিন ফিফটি। অথচ ভারতের সাথে সিরিজে খেলার সুযোগ পেলেন মাত্র একটি  ম্যাচ। হয়তো সে আক্ষেপ থেকেই হাবিবুল বাসারের নেতৃত্বে পাড়ি জমিয়েছিলেন ভারতের নিষিদ্ধ লীগ আইসিএলে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও ঐখানে যাওয়া সব ক্রিকেটারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পরে অবশ্য তাদের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।

এরপর নিউজিল্যান্ড সিরিজে জাতীয় দলে আবার ফেরেন।  পঞ্চাশ পেরেনো একটি ইনংস খেললেও  তামিম  চোট থেকে ফিরলে আবারো বাদ পড়তে হয় জাতীয় দল থেকে।
পরে অবশ্য  ২০১১ বিশ্বকাপে ২ ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। একম্যাচে ৩৭ এবং আরেক ম্যাচে ৫ রান করে নিজেকে তেমন করে তুলে ধরতে পারেনি নাফিস। বিশ্বকাপ পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ সফরে আসে। সিরিজের তিনটে ম্যাচই শাহরিয়ার নাফিস খেলেন। প্রথম ম্যাচে শূন্য রানে প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলেও পরের দুই ম্যাচে করেন ৬০ এবং ৫৬ রান।

কিন্তু সেবছর টানা ৬টি ওয়ানডেতে রানের দেখা না পেলে ওয়ানডে দল থেকে বাদ পড়েন। এরপরে টেস্টেও তেমন কোন বড় ইনিংসের দেখা মেলেনি ২০১১ সালের ৯৭ রানের ইনিংসটি ছাড়া।  নিজের বাজে ফর্মের কারনে বাদ পড়েন টেস্ট দল থেকেও। ২০১৩ সালে হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন।


ফর্ম হারিয়েছেন। আবার ফর্মে ফিরেছেন। বিপিএলে প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে সেঞ্চুরি করেছেন। ঘরোয়া লীগে বছরের পরে বছর রানের  ফোয়ারা ছুটিয়েছেন। তবু নির্বাচকদের মন গলাতে পারেননি। ফুটিয়ে তুলতে পারেননি  ক্যামেলিয়া ফুল। লজ্জাবতীর মতো চুপসে গেছেন। আর সমর্থকদের মনে হয়ে আছেন  আক্ষেপের বানি --  আহ! হতে পারতেন তিনি দেশসেরা খনি।

অথচ তিনি হয়ে রইলেন সমর্থকদের মনের বেলের কাঁটা। যে কাঁটা বছরের পর বছর একটু একটু করে পীড়া জাগাবে!