ইতিহাস খ্যাত দূর্গ নারিকেলবাড়িয়ার তিতুমীরের  বাশের কেল্লা

সব নক্ষত্র সর্বদা উজ্জ্বল দেখা যায়না কিছু কিছু আঁধারে থেকে যায়। তেমই কিছু কিছু ব্যাক্তি আছেন যারা ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থেকে যান আজীবন। ইতিহাসে এমনই একজন ব্যাক্তি আছেন যার নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী,  এ নামে হয়তো অনেকেই তাকে চিনবেন না আসলে সৈয়দ মীর নিসার আলী হলেন তিতুমীর।  ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা তাঁকে স্মরণ করেন ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়াকু সৈনিক হিসেবে। আর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও কৃষক সংগঠন তাঁকে মনে করে অত্যাচারী জমিদার এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কৃষক নেতা হিসেবে। তিতুমীর ছিলেন বৃটিশ-বিরোধী এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন মহান বীরযোদ্ধা। সৈয়দ মীর নিসার আলীর কথা উঠলে তার সাথে মনে পড়ে তার বাঁশের কেল্লার কথা। কেননা তিতুমীর আর বাঁশের কেল্লা কথা দুইটি যেন একটির সাথে অন্যটি ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা নিয়ে আছে অনেক গল্প কাহিনী, রয়েছে পাঠ্য বইয়ে দুই একটা লেখাও। 
বাংলার ইতিহাসে তিতুমীর এক আলোকিত নাম। তিতুমীরের জন্ম হয় ১৭৮২ সালে পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার বাদুড়িয়া থানার হায়দারপুর গ্রামে। তার পিতার নাম সৈয়দ মীর হাসান আলী ছিলেন একজন কৃষকএবং মাতার নাম আবিদা রোকেয়া খাতুন গৃহিনী। তিতুমীরের প্রাথমিক শিক্ষা হয় তার গ্রামের বিদ্যালয়ে। পরবর্তীকালে তিনি স্থানীয় একটি মাদ্রাসাতে লেখাপড়া করেন। ১৮ বছর বয়সে তিতুমীর কোরানে হাফেজ হন এবং হাদিস বিষয়ে পাণ্ডিত্য লাভ করেন। ১৮২২ সালে তিতুমীর মক্কায় হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশ্যে যান। তিনি সেখানে স্বাধীনতার অন্যতম পথপ্রদর্শক সৈয়দ আহমেদ শহীদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ও ওয়াহাবী মতবাদে অনুপ্রাণিত হন। সেখান থেকে এসে তিতুমীর তার গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের সাথে নিয়ে জমিদার এবং ব্রিটিশ নীলকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। তিনি এবং তার অনুসারীরা তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ধুতির বদলে 'তাহ্‌বান্দ' নামে এক ধরনের বস্ত্র পরিধান শুরু করেন।


তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা কেন এতো বিখ্যাত?

তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা এখন শুধু এক স্মৃতি। তিতুমীর সর্বদা ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান করতেন। কিন্তু একজন সাধারন মানুষ হয়ে একটি দেশের সরকারের সাথে বিরোধিতা করা অনেকটা জলে বাস করে কুমিরের সাথে লড়াইয়ের মত। তাই এক সময় তিতুমীরের মনে হল ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হলে প্রয়োজন সমর প্রস্তুতি ও উপযুক্ত সেনা-প্রশিক্ষণ। আর সে জন্য সেনাবাহিনীর আত্নরক্ষার প্রয়োজনে তিনি একটি দুর্গ নির্মানের প্রয়োজনীতা গভীরভাবে অনুভব করেন। ১৮৩১ সালের ২৩শে অক্টোবর বারাসতের কাছে বাদুড়িয়ার ১০ কিলোমিটার দূরে নারিকেলবাড়িয়া গ্রামে তাঁরা একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন।  সময় এবং অর্থাভাবে তিনি শুধু নারিকেলবাড়িয়া নামক স্থানেই একটি বাশের কেল্লা  নির্মান করেছিলেন। ইতিহাসে এ কেল্লাই নারিকেলবাড়িয়া বাঁশের কেল্লা নামে বিখ্যাত। বাঁশ এবং কাদা দিয়ে  নির্মাণ করা হয়েছিল দ্বি-স্তর বিশিষ্ট এ কেল্লা।


১৮৩১ সালের নভেম্বর মাসের কথা। কেবল সন্ধ্যা নামবে এমন একটা সময়ে ইংরেজ বাহিনী ঘিরে ফেলে নারিকেলবেড়িয়া গ্রাম। তাদের উদ্দেশ্য তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ধ্বংস করা। সেই মুহূর্তে আক্রমন না করে রাতে ইংরেজ বাহিনীর ওপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন  তিতুমীর। তাঁর নির্দেশে সেনাপতি মাসুম খাঁ আক্রমণ পরিচালনা করেন। তীর-ধনুক, বর্শা, ইটের টুকরা আর কাঁচা বেলের আক্রমণে ইংরেজ বাহিনীর অনেকেই আহত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরের দিনে ইংরেজ বাহিনীর দায়িত্বে থাকা কর্নেল একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এনে তিতুমীর বাহিনীকে গ্রেপ্তারের আহ্বান জানিয়ে কেল্লার প্রধান দরজায় তরবারি দিয়ে গেঁথে দেয়। এতে তিতুমীর বাহিনীর কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। কর্নেল তার নিজ বাহিনীতে ফিরে গিয়ে কেল্লা আক্রমণের নির্দেশ দেয়। বাহিনী কেল্লা তাক করে শুরু করে গুলিবর্ষণ। বন্দুকের মুহুর্মুহু গুলিতে অস্থির করে ফেলে কেল্লার বাসিন্দাদের। বেশ কিছু কামান তাক করে রাখা হয় কেল্লার দিকে। আত্মসমর্পণ না করলে এ কামান ব্যবহার করতে দ্বিধা করবে না ইংরেজ বাহিনী। কিন্তু এত কিছুর পরও আত্মসমর্পণ না করে পাল্টা আক্রমন শুরু করে তিতুমীর। এই পাল্টা আক্রমণে আহত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয় ইংরেজ বাহিনী। এমন আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ চলে বেশ কয়েক দিন। তিতুমীর এমন অসম যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকেন ধীরস্থিরভাবে। তারা আত্মসমর্পণ না করায় এই অসম যুদ্ধে একসময় কামান ব্যবহার করতে শুরু করে ইংরেজরা। ভেঙে পড়তে শুরু করে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা। হঠাৎ একটি কামানের গোলা আঘাত করে তিতুমীরের ডান ঊরুতে। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তাঁর পা। ১৯ নভেম্বর এভাবেই লড়তে লড়তে স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দেন অকুতোভয় বীর তিতুমীর। ধ্বংস হয়ে যায় তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা। এদিনে গ্রেপ্তার করা হয় তিতুমীরের সেনাপতি মাসুম খাঁসহ আট শতাধিক বীর যোদ্ধাকে।


বিপ্লবী, বিদ্রোহী শহীদ তিতুমীর শুধু ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধেই লড়াই করেননি, তিনি বাংলার জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করেছিলেন, প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তাঁর বাঁশের কেল্লা থেকে। ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তিতুমীরের নাম উজ্জল হয়ে আছে। তিনি সর্বপ্রথম ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে লড়াই করে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
তিতুমীর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণার উৎস হিসাবে কাজ করেছে। ১৯৭১ সালে মুহাম্মদ জিন্নাহ কলেজ কে তার নাম অনুসারে সরকারী তিতুমীর কলেজ নামকরণ করা হয়। তার নামে বুয়েট এ একটি ছাত্র হলের নামকরণ করা হয় তিতুমীর হল। বিবিসির জরিপে তিনি ১১ তম শ্রেষ্ঠ বাঙালি।