২০০৭ সালের  টি-টুয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালের কথা মনে আছে? শেষ চার বলে  পাকিস্তানের প্রয়োজন ছিল ৬ রান। শেষ উইকেটে মিসবাহ-উল-হক  যোগীন্দ্র শার্মার  তৃতীয়  বল আকাশে ভাসিয়ে মারলে শ্রীশান্তের তালুবন্দী হন। ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ন। সেসময়ে এ ম্যাচটি যারা সরাসরি দেখেছে, তারা ম্যাচটিকে জমজমাটই বলবে। কিংবা  ১৯৮৭ সালের একদিনের ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালটিকে কি জমজমাট বলা  যাবে? ইউটিউব খুঁজলে হয়তো পেয়ে যাবেন। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ইংল্যান্ড হেরে যাই ৭ রানে। সমর্থকেরা সেটিকেও হয়তো জমজমাটের তালিকাতেই রাখবে।  এছাড়া কোন ফাইনালই তেমন করে আর কখনো জমে ওঠেনি। একজন সমর্থকের মনে যতো অতৃপ্তি কোণঠাসা হয়ে ছিল, তা  বোধহয়  ঘুচে গেলো ২০১৯ সালের  ১৪ জুলাই। অনুষ্ঠিত হয় একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বিশ্বকাপের দ্বাদশ আসরের ফাইনাল! মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড। অবশ্য সে ম্যাচটিকে  কোনভাবে জমজমাট বলা চলে না, বরং অবিশ্বাস্য,অভাবনীয়, অকল্পনীয়, অতুলনীয় এর মতো বিশেষণে বিশেষায়িত করাই শ্রেয়। নতুন করে লেখার কিছুই নেই। তবু স্মৃতি রোমন্থনের জন্য তো লেখায় যাই।



ক্রিকেটের মক্কা খ্যাত লর্ডসে নিউজিল্যান্ড আর স্বাগতিক ইংল্যান্ডের মধ্যকার ফাইনালের মাধ্যমে টুর্নামেন্ট শেষ হতে যাচ্ছে। নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক  কেন উইলিয়ামসন টসে জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয়। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই নিউজিল্যান্ড মাঝারি মানের পুজি নিয়েই লড়াই করেছে। ঠিক কতটা মাঝারি তা সেমিফাইনাল পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডের স্কোরকার্ডের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। পুরো টুর্নামেন্টে মাত্র একবারই ২৫০ রানের কোটা পার করতে পেরেছে। সেটাও উইন্ডিজের বিপক্ষে ২৯১। ফাইনাল বা এর বাইরে কি করে হয়! হেনরি নিকোলসের ৫৫ আর লাথামের ৪৭ রানের ওপর ভর করে নিউজিল্যান্ডের  সংগ্রহ   ৫০ ওভারে  ৮ উইকেটে ২৪১। বিশ্বকাপ জিততে ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ২৪২! ২০১৫ বিশ্বকাপের পর যারা ইংল্যান্ডের খেলার ভক্ত বনে গেছেন, তারা হয়তো ভাবতেই পারেন - এ আর এমন কি! কিন্তু বিশ্বকাপ ফাইনালের একটা চাপ তো থেকেই যাই। অনেকের মনে হয়তো উকি দিয়েছিল, ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ফাইনাল, ২০১৬ টি-টুয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপের ফাইনাল আর চ্যাম্পিয়নস ট্রফি-২০১৭ এর সেমিফাইনাল! কেননা পরাজিত সবকয়টি দলের নামই ইংল্যান্ড। ফাইনালের চাপ নিতে পারবে কিনা, মনের মাঝে সে প্রশ্নের উকঝুকির মাঝেই ব্যাট হাতে নামলেন জেসন রয় আর জন্নি বেয়ারস্টো।



কিছুক্ষণের মধ্যে ২৪২ রানই পর্বতসমান হয়ে গেল ইংলিশদের সামনে। ৮৬ রানের মধ্যে টপ অর্ডারের ৪ ব্যাটসম্যান নেই। একেএকে  ফিরে গেছেন রয়,রুট,বেয়ারেস্টো,মরগান। এরপরে ব্যাট হাতে নামেন জস বাটলার। স্টোকস আর বাটলার মিলে গড়ে তোলেন  ১১০ রানের জুটি। তবে মোক্ষম সময়ে সে জুটিও ভাঙে নিউজিল্যান্ড। এরপর একা হাতে লড়ে গেলেন স্টোকস।

ম্যাচের নাটক জমে ওঠে শেষ ওভারে। ইংল্যান্ডের শেষ ওভারে প্রয়োজন ১৫। স্ট্রাইকে বেন স্টোকস।নিউজিল্যান্ড ক্যাপ্টেন উইলিয়ামসন শেষ ওভার তুলে দিলেন  ট্রেন্ট বোল্টের হাতে।  বোল্টের প্রথম ২ বলে কোন রান নেই। বোল্ট যেন প্রমাণ করতে বসলেন, অধিনায়কের তার হাতে বল তুলে দেওয়া যথার্থ। ইংল্যান্ডের প্রয়োজন শেষ ৪ বলে ১৫। অনেকেরই মনে হতে শুরু করেছে বিশ্বকাপ স্বপ্ন বোধহয় শেষ। সে স্বপ্নে একটুখানি আশার প্রদীপ হয়ে নিভুনিভু করে জ্বলছে লাখো  ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে  বেন স্টোকস। আর তখনই ওভারের তৃতীয় বলে স্টোকস হাটু গেড়ে মিডউইকেটের ওপর দিয়ে মারলেন ছক্কা।


৩ বলে প্রয়োজন ৯! ঠিক  তখনই ঘটলো ম্যাচের সবথেকে নাটকীয় ঘটনা।  লেগ সাইডে বল পাঠিয়ে স্টোকস ছুটলেন দুই রানের জন্য। মার্টিন গাপটিলের থ্রো  স্টোকসের ব্যাট ছুঁয়ে সোজা মাঠের বাইরে। ইংল্যান্ড পেয়ে যায় আরো ৬ রান। এনিয়ে খানিকটা খটকা ছিল মাঠেও, বেন স্টোকস সাথে সাথে হাত উঠিয়ে জানান দেন যে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যাট বলে লাগাননি। প্রথমে দৌঁড়ে নেয়া দুই রানের সাথে যোগ হয় ওভারথ্রোতে আসা চার, মোট রান হয় ছয়।

শেষ দুই বলে ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ৩ রান। তবে বেন স্টোকস নিতে পারলেন ২ রান। ম্যাচ টাই! খেলা গড়াবে সুপার ওভারে।



স্নায়ুক্ষয়ী সব মুহূর্ত পেরিয়ে শুরু হলো সুপার ওভার। সুপার ওভারে  টান টান উত্তেজনায় খেলোয়াড়েরা। পুরো বিশ্বের সমস্ত সমর্থকের মনের মাঝেও উত্তেজনার ঢেউ খেলে যেতে লাগলো কেননা এমন ফাইনাল এর আগে একটাও দেখেনি বিশ্ব! ইংল্যান্ড করল ১৫ রান। নিউজিল্যান্ডও করল ঠিক ১৫! সুপার ওভারেও ম্যাচ টাই। তখন দেখা হলো, ম্যাচে বাউন্ডারি বেশি কাদের। ইংল্যান্ড তাতেই চ্যাম্পিয়ন! আর তাতে ক্রিকেটীয় ইতিহাসের একমাত্র ম্যাচ হিসাবে লেখা থাকবে , ২৬-১৭  বাউন্ডারির ব্যবধানে বিশ্বকাপজয়ী ইংল্যান্ড।

কোন এক বিকালে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আপনার মনে পড়বে, নিউজিল্যান্ড ক্যাপ্টেন উইলিয়ামসনের হাসিখুশি মুখখানা। হয়তো চাপা কষ্টকে সমাধি দিয়েছিলেন বুকের মাঝেই। হয়তবা আপনাকে শেখাবে, দুঃসময়ে কেমন করে মুখে এক চিলতে হাসি রাখা যাই। হয়তো কোন একদিন আবারো আফসোস করেই মুখ থেকেই বেরিয়ে আসবে, সেবার আইসিসির উচিৎ ছিলো যৌথচ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা। আর সবকিছু পেরিয়ে হয়তো এমন ম্যাচের সাক্ষী হতে পেরেই  নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবেন। হয়তবা  বছর ত্রিশ পরে বেঁচে থাকলে নাতি-নাতনিদের গল্প করেই শুনাবেন এ ম্যাচের গল্প। কে জানে কত কিছুই তো হতে পারে! শুধু মিটবে না মার্টিন গাপটেলের করা থ্রোর আক্ষেপ!