পূর্ণিমারাতে জোছনা দেখতে কার না ভালো লাগে! জোছনা রাতের ওপর অভিভূত হয়ে লেখক হুমায়ূন আহমদ তো লিখেই গেছেন - ও কারিগর, দয়ার সাগর,  ওগো দয়াময়! চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়।  অথচ যে চাঁদ থেকে  এত সুন্দর জোছনা পাওয়া গেলো, সে চাঁদেরও আছে কলঙ্ক। 

গোলাপ ফুলকে কে না ভালোবাসে! কত তরুনের মনের আকুতি এক তোড়া গোলাপেই প্রকাশ পেয়েছে তার হিসাব বা কে রাখে! অথচ সেই গোলাপেও আছে কাঁটা।


বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সমর্থকদের বেশকিছু  সুখস্মৃতি দিয়েছে। সেই সাথে আছে কিছু করুণ সুরও। সেই সুরে বংশীবাদক  তার বাশি হয়তো বাজাতে চাইবে না। কিন্তু তবু বারবার করুণ সুরই খুঁজে নিতে হয় জীবনের তাগিদে। ২০১২ এর এশিয়া কাপ ফাইনাল তো দেশের ক্রিকেটের করুণ সুরই।তবে সেটাকে কি কলঙ্ক বা গোলাপ কাঁটার সাথে তুলানা কারা যাই! নাকি চাপা কান্না বলাই শ্রেয়!

নাজিমুদ্দিন, নাসির হোসেন, এনামুল বিজয়দের মতো তরুনদের সাথে তামিম-সাকিব-মুশফিক-মাশরাফির অভিজ্ঞতার মিশেলে ১৫ সদস্যের স্কোয়াডটি ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে ভালো কিছু করে দেখানোর সম্ভাবনা তৈরী করেছিলো তো বটেই, সেইসাথে গ্রুপ পর্বে ভারত- শ্রীলঙ্কার মতো দলকে উড়িয়ে দিয়ে ফাইনালে  যাওয়া বাংলাদেশকে নিয়ে সমর্থকের শিরোপা জয়ের স্বপ্ন দেখা হয়তবা বিন্দুমাত্র ভুল নয়।

২০১২ সালের ২২ এ মার্চ, সে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিপক্ষে  ঘরের মাঠে ফাইনাল খেলতে নাম বাংলাদেশ দল। মিরপুরের মধ্যদুপুরে টসে জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ক্যাপ্টেন মুশফিকুর রহিম। 


অধিনায়কের সিদ্ধান্তই যে যথার্থ, তা  প্রমাণ করতে নাজমুল-মাশরাফিদের লেগেছিল ৫ ওভারের মতো। মাত্র ১৯ রানের  মাঝেই ফিরে গেলেন নাসির জামশেদ আর ইউনিস খান। দলীয় ৫৫ রানের মাথায় অধিনায়ক মিসবাহ উল হককে দূর্দান্ত এক রান আউট করেন নাসির হোসেন। ৭০ রানের মাথায় আব্দুর রাজ্জাকে কাটা পড়েন ৪০ করা মোহাম্মদ হাফিজ। পাকিস্তানের টপ অর্ডার ব্যর্থতা ভালোভাবেই ম্যাচে রেখেছিল বাংলাদেশকে।

হামাদ আজমকে সঙ্গে নিয়ে শুরুর ধাক্কা ভালোভাবেই সামাল দেন ওমর আকমল। গড়ে তোলেন  ৫৯ রানের জুটি। এরপরে আবারো খেই হারিয়ে ফেলে পাকিস্তান। ১৩৩ রানের মধ্যে ফিরে যান উমর আকমল আর হামাদ আজম। এরপরে আফ্রিদির স্বভাব সুলভ ২২ বলে ৩২ আর একপাশ আগলে রেখে সরফরাজ আহমেদের ৪৬ রানের ইনিংসে  পাকিস্তান পেয়ে যাই মাঝারি মানের লড়াই করার মতো পুজি। ৫০ ওভার শেষে পাকিস্তানের সংগ্রহ ৯ উইকেটে ২৩৬।

তবে পাকিস্তানের ইনিংসের শেষ ওভারের কথা আলাদাভাবে না বললে নয়। ইন্জুরীর কারনে নিজের বোলিং কোটা শেষ করতে পারেননি নাজমুল হোসেন। মাহমুদুল্লাহকে দিয়ে ক্যাপ্টেন মুশফিক হাত ঘুরিয়েছেন গোটা তিনেক ওভার। শেষ ওভারে কার হাত বল তুল দিবেন? সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তিতও দেখা গেল মুশফিককে। বল তুলে দিলেন শাহাদাত রাজীবের হাতে।৪৯ ওভারে পাকিস্তানের সংগ্রহ ৯ উইকেটে ২১৭। রাজীব শেষ ওভারে রান বিলি করলো মুক্ত হস্তে। দিলেন ১৯ রান। পাকিস্তান করলো ২৩৬। বিশেষজ্ঞ অনেকেই মনে করেন, পাকিস্তান ইনিংসের শেষ ওভারটি পাকিস্তানের জয় পেতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।



২৩৭ রানের লক্ষ্যে  ব্যাট করতে নেমে  ওমর গুলের বলে নাস্তানাবুদ হতে থাকে নাজিম উদ্দিন। তবে অপর পাশে তামিম ইকবাল স্বাচ্ছন্দ্যেই ব্যাট চালিয়ে যাই। প্রথম উইকেট জুটিতে  ১৪ তম ওভারে এসে  পঞ্চাশ পেরোই বাংলাদেশ। তবে সেখানে তামিমের অবদানই সিংহভাগ। দলীয় ৬৮ রানের মাথায় শহীদ আফ্রিদির বলে ৫২ বলে ১৬ করে প্যাভিলিয়নে ফেরেন নাজিম উদ্দীন। এরপরে ৮১ রানের মধ্যেই ফিরে যান জহুরুল-তামিমরা (তামিম ফেরেন ব্যক্তিগত ৬০ রানে)।

ফাইনালের চাপ এসে পড়ে সাকিব-নাসিরদের কাধে। সেই চাপ থেকেই হয়তো অতি রক্ষণাত্মক ব্যাটিং শুরু করেন নাসির হোসেন। ৮৯ রানের একটা জুটি সাকিবের  সাথে গড়লেন ঠিকই কিন্তু তাতে অবদান ৬৩ বলে ২৮। সাকিব অবশ্য সাবলীল ভাবেই ব্যাট চলাচ্ছিলেন।

সাকিব-তামিমের সাবলীল ব্যাটিংয়ে নাসির-নাজিম উদ্দিনের অতি রক্ষণাত্মক ব্যাটিং  ৪৩ ওভার পর্যন্ত বাংলাদেশ ইনিংসে তেমন কোন ছাপ ফেলেনি। তবে ৪৫ ওভারের মধ্যে সাকিব-মুশফিক ফিরে গেলে খেলায় ফেরে পাকিস্তান। শেষ ৫ ওভারে বাংলাদেশের জিততে প্রয়োজন ৪৭। হাতে আছে ৪ উইকেট। মাশরাফির  ৯ বলে ১৮ রানের ছোট্ট প্রাণবন্ত ইনিংসটি বাংলাদেশকে জয়ের সুবাস এনে দিচ্ছিলো। কিন্তু দলীয় ২১৮ রানের মাথায় সাইদ আজমলের বলে প্যাভিলিয়নে ফেরেন তিনি।

শেষ ২ ওভারে প্রয়োজন ১৯। ব্যাটিংয়ে রিয়াদের সাথে রাজ্জাক। ৪৯তম ওভার থেকে নিতে পারেন ১০ রান। ফলে শেষ ওভারে প্রয়োজন  ৯। বোলার আইজাজ চিমা। আগের ৬ ওভারে বিলিয়েছেন ৪০ রান। অথচ প্রথম ৪ বলে আসে মাত্র ৫ রান। এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে চ্যাম্পিয়ন হতে শেষ ২ বলে প্রয়োজন ছিল ৪ রান। আইজাজ তার পঞ্চম বলে স্টাম্প খুলে দেন রাজ্জাকের। শেষ বলে প্রয়োজন বাউন্ডারি। কিন্তু লেগ বাই থেকে আসে মাত্র ১। বাংলাদেশ ম্যাচ হারে দুই রানে।


সাথেসাথেই পাকিস্তানের উল্লাস শুরু হয়ে যাই। আইজাজ চিমা দৌড়ে গিয়ে মিসবাহ-উল হককে জড়িয়ে ধরে। বিজয়ী দলের আনন্দের মাঝে  বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে  পরাজিত দলের  দুঃখ-কষ্ট নির্লিপ্ত হয়ে যাই। কিন্তু এখানে হলো ঠিক  উল্লোটা। সেটার কারন সম্ভবত মিরপুর নিজদের ঘরের মাঠ বলে।


মুশফিক-তামিমরা কাঁদছেন। চোখের কোনে পানি এসে জমেছে নবাগত এনামুলেরও। হয়তো সাকিবকে জড়িয়ে ধরেই নিজেকে আড়াল করতে চাইলেন মুশফিক! অথচ সেই সাকিবের চোখেমুখে ও বিষাদের সুর। সেই সুর ছুয়ে গেছে মিরপুরের দর্শকের মাঝে, সেখান থেকে ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়ে। আজ যে ছেলেটা যৌবনে পা দিয়েছে, সেসময়ের সেই টিন এজার ছেলেটি,  আজ সহস্র রাত পেরিয়েও বুকের মাঝে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করে! স্মৃতি হাতড়াতে  গিয়ে চোখের কোণে  চলে আসে একটুখানি পানি। এরই নাম কি চাপাকান্না!