পৃথিবীতে এমন কিছু অদ্ভুত জায়গা আছে যা মানুষকে শুধু হতবাকই করে না সাথে সাথে ভাবতেও বাধ্য করে। কিছু জিনিস আছে যেগুলোর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হয় আবার কিছু জিনিসের অস্তিত্ব কে কোনো ভাবেই স্বাভাবিক ভাবে মানতে পারা যায় না। এরকমই পৃথিবীতে এমন একটি ভয়াবহ হ্রদ রয়েছে যেখানে কিছুক্ষন অবস্থান করলেই যেকোন প্রানী মমিতে পরিণত হয়। যার নাম লেক ন্যাট্রন। আফ্রিকার তানজানিয়া আরুশা অঞ্চলে এই হ্রদটির অবস্থান। পৃথিবীতে বিখ্যাত ফটোগ্রাফারদের ক্যামেরায় ধরা পড়া আকর্ষনীয় অনেক ছবি এখানে তোলা হয়েছে। ছবিগুলোতে নিরল্কুশ লক্ষ্য করা যায় প্রাণী গুলো যেন অজান্তেই হ্রদের পানিতে নেমে মমিতে পরিনত হয়েছে আরা ফটোগ্রাফার সেই সুজোগটা কাজে লাগিয়েছে। লেকের পাশে আছে একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে যার নাম ওল দইন্নো লেঙ্গাই। খুবই বিরল প্রকৃতির এই আগ্নেয়গিরি সর্বদা  একটি সোডিয়াম কার্বেনেট ও পটাশিয়াম কার্বোনেট সমৃদ্ধ লাভা উদগিরন করে যা ন্যাট্রন নামে পরিচিত।  আর এটি এতোটাই ক্ষারীয় যে ন্যাট্রন লেকের pH মাত্রা সবসময় ১০.৫ এর উপরে থাকে। প্রাচীন মিশরে মমি বানানোর কাচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হত এই পদার্থ। 



 মজার ব্যাপার হলো এই লেকের পানিতে নেমে সাথে সাথে উঠে গেলে কোন অসুবিধা নেই কিন্তু কোন প্রানী যদি কিছু সময় এই পানিতে অবস্থান করে তাহলে চামড়া শুষ্ক হয়ে উঠে।
ন্যাট্রন লেকটি গ্রেগরি রিফ্টে অবস্থিত , যা পূর্ব আফ্রিকান রিফ্টের পূর্ব শাখা। এই হ্রদটি আন্তর্জাতিক তাৎপর্যপূর্ণ রামসার সাইট জলাভূমি হ্রদ ন্যাট্রন বেসিনের মধ্যে রয়েছে। হ্রদটি মূলত দক্ষিণ এভাসো এনজিওরো নদী দ্বারা পুষ্ট। এটি মধ্য কেনিয়ায় সৃষ্ট হয়েছে। অনেক খনিজ সমৃদ্ধ গরম প্রস্রবণ দ্বারাও পুষ্ট। হ্রদটি বেশ অগভীর, তিন মিটারেরও কম (৯.৮ ফুট) গভীর, এবং এর জলের স্তর অনুসারে প্রস্থে পরিবর্তিত হয়। হ্রদটি সর্বোচ্চ ৫৭ কিলোমিটার (৩৫ মাইল) দীর্ঘ এবং ২২ কিলোমিটার (১৪ মাইল) প্রশস্ত। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলটিতে অনিয়মিত মৌসুমী বৃষ্টিপাত হয়, মূলত ডিসেম্বর থেকে মে মাসে প্রতি বছর মোট ৮০০ মিলিমিটার (৩১ ইঞ্চি) হয়। হ্রদে তাপমাত্রা প্রায় ৪০ °C(১০৪ °F) এর উপরে থাকে।



কথিত আছে এই হ্রদটির লবণাক্ততা এতোই তীব্র যার কারণে এর সংস্পর্শে কোন প্রাণী আসামাত্রই পাথরে পরিণত হয়ে যায়। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে ধুসর রঙের ফ্লামিংগ পাখি, বাদুরসহ বেশকিছু প্রাণীর জমে যাওয়া দেহাবশেষ, যা হয়তো পানিতে ভাসছে বা ডালে বসে আছে, হেটে চলছে এ হতে অনেকেই ধারণা করে বসেন এসব প্রাণী যখনই লবণাক্ত পানির সংস্পর্শে এসেছে তখনই মারা গিয়েছে এবং পাথরে পরিণত হয়ে গিয়েছে।
এই হ্রদটি পূর্ব আফ্রিকার একমাত্র নিয়মিত প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয় যেখানে প্রায় দেড় মিলিয়ন লেজার ফ্লেমিংগো দেখা যায়। লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেলে এই হ্রদের সায়ানোব্যাকটেরিয়া ও বৃদ্ধি পায় এর ফলে আরো বেশি লেজার ফ্লেমিংগো প্রজননের জন্য আসে এবং বাসা বাঁধে। এই পাখি গুলো সাধারণত স্পিরিলুনা নামক নীলচে-সবুজ রং এর লাল পিগমেন্টের শৈবাল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এই হ্রদ লেজার ফ্লেমিংগো পাখির প্রজননের জন্য অত্যন্ত নিরাপদ স্থান। এই লেকের পানির পিএইচ মান ৭-১০ আবার মাঝে মাঝে ১২ এর বেশি থাকে এবং তাপমাত্রা প্রায় ৪০°c এর কাছাকাছি। এই জন্য এই হ্রদ লেজার ফ্লেমিংগো বাদে বাকি সব পশু পাখির জন্য নরকের মত। কারণ এই পিএইচ মান ও তাপমাত্রা যেকোনো অনভ্যস্ত পশু পাখিকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট। এমনকি কোনো মানুষ ও এই হ্রদে নেমে সাঁতার কাটতে পারে না। কারণ এই অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি চোখ, ত্বক পুড়িয়ে ফেলার মত। বিজ্ঞানীগণ বলেন এই হ্রদে থাকা ব্যাকটেরিয়া গুলোর জন্য হ্রদের তাপমাত্রা ১৪০° ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে।



এই হ্রদটির কোনো সীমা নাই অর্থাৎ এই হ্রদটির সাথে কোন নদী বা সাগরের সংযোগস্থল নাই যার ফলে বাইরের কোন নদী বা সাগরের পানি এতে মেশে না। ফ্লামিংগ প্রজাতির পাখিদের এই হ্রদকে নিজেদের প্রজননক্ষেত্র হিসেবে নির্দিষ্ট করার পিছে রয়েছে আরেক কারণ যা হলো নাট্রন হ্রদের পরিবেশ যথেষ্ট প্রতিকুল আর অন্যান্য শিকারী প্রাণীদের এখানে বেঁচে থাকার অনুপযোগী। যার ফলে ফ্লামিংগরা থাকে নিরাপদ। তাছাড়া উচ্চমাত্রার লবণ এবং তাপমাত্রা থাকা সত্ত্বেও এই পানি তারা অনায়াসে পান করতে পারে। ঠিক এ কারণগুলোর জন্যেই এমন একটা স্থানকেই ফ্লামিংগ পাখিদের প্রজননের জন্য বেছে নেয়ার মূল কারণ।
রাসায়নিকভাবে অত্যন্ত ঘন জল উচ্চ প্রতিফলনের সৃষ্টি করে। যার ফলে লেকের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া পরিযায়ী পাখিরা দিকভ্রান্ত হয়ে লেকের উপরের স্তরে এসে ধাক্কা মারে। ও মারা যায়। লেকের জল যখন কমে যায়, এই সমস্ত প্রাণীদের দেহ লেকের তীরে পরে থাকতে দেখা যায়। জলে অতিমাত্রায় লবণ ও সোডা থাকায় মৃতদেহগুলো সংরক্ষিত হয়ে থাকে।জলে আগ্নেয়গিরি থেকে বের হওয়া ছাই মিশ্রিত থাকে। (যা মিশরে মমি সংরক্ষণে ব্যবহার করা হতো)। ফলে মনে হয় মৃতদেহ পাথরে পরিণত হয়েছে। নিক যখন ঔ জায়গায় পৌঁছন, তিনি প্রাণীদের মৃতদেহ পরে থাকতে দেখতে পান। তিনি মৃতদেহগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে (পোজ দিয়ে) ছবি তোলেন। ছবি বাস্তব সম্মত করার জন্য কোনোটা গাছের ডালে, কোনোটা লেকের জলে রেখে ছবি তোলেন।আসলে তারা ঐ রকমভাবে বসে নেই। তবে প্রাণীদের দেহ সংরক্ষিত হয়ে যায়, এটা ঠিক।



এসব প্রাণীর মৃত্যু হ্রদের লবণাক্ত পানির সংস্পর্শে আসা নয় বরং এর কিছু যৌক্তিক কারণ হিসেবে বলা যায়, নাট্রন হ্রদের পিএইচের মাত্রা প্রায় ১০.৫ বা এর কিছু বেশি আর এই পানির সাথে অভ্যস্ত নয় এমন কেউ এর সংস্পর্শে আসা মাত্র চোখ এবং চামড়া মুহূর্তেই ঝলসে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। হ্রদের ক্ষারযুক্ত পদার্থ মূলত সোডিয়াম কার্বোনেট এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থ হতে উৎপন্ন হয় যা আসে হ্রদের চারপাশের ঘেরাও করা পাহাড়-পর্বত হতে। সোডিয়াম কার্বোনেট – যা মিশরের মমি তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো – এক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে সেসব পশুপাখির মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য যারা অসাবধানতা এবং দুর্ভাগ্যবশত নাট্রন হ্রদে মারা যায়। এই নাট্রন হ্রদের ক্ষারীয়তা বরঞ্চ এটা জীবনদান করে লবণাক্ত জলাভূমি, স্বচ্ছ পানির জলাভূমি, ফ্লামিংগ এবং জলাভূমির পাখিদের প্রজনন ও খাদ্য উৎপন্ন করত: ইকোসিস্টেমের ব্যালেন্স রক্ষার্থে সহায়তা করে।
লেক ন্যাট্রনে প্রচুর পর্যটকের আকর্ষণ কেন্দ্র। কিন্তু যথাযথ ব্যাবস্থার অভাবে এই লেক এখানো পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয়নি। লেক ন্যাট্রন ঘুরে দেখার ভালো সময় হলো জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত। শুকনো মৌসুম হ্রদে ঘুরে বেড়ানো এবং ট্র্যাকিংয়ের জন্য উপযুক্ত সময়।