হিমুর কথা মনে আছে । হুমায়ূন আহমেদ পরম মমতায় লিখেছেন এই চরিত্রটিকে । পকেটহীন হলুদ পান্জাবী পরে শহরের দূর-দূরান্তে খালি পায়ে উদ্দেশহীনভাবে হেটে বেড়াতো। পূর্ণিমারাতে গাজীপুরের শালবনে গিয়ে চাঁদের আলো খেতো । কিংবা কখনো কখনো অকারণেই মানুষকে উদ্ভ্রান্ত করা ছিলো তার প্রধান কাজ । আর তার বান্ধবী রুপার কথা কি মনে পড়ে ! নীল রঙের শাড়ি পরে বেলকনিতে  দাড়িয়ে থাকাতো বন্ধু হিমুর অপেক্ষায়  অথচ কখনো দেখা করতেই যাইনি হিমু ছেলেটি । ৯০ এর দশকে "ময়ুরাক্ষী" এর তীরে প্রথম পাঠকদের সাথে মেলে হিমালয় হিমু । এরপরে কখনো মাজেদা খালা-ফাতেমা খালার বাড়ি হয়ে গাজীপুরের শালবনে পূর্ণিমা দেখতে কতবারই তো মিলেছে । 

লেখক হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন ২০১২ সালে । এরপর থেকে আর দেখা মেলেনি হিমালয়ের । তবে পাঠকদের  অনেকেই হলুদ পান্জাবী পরে খালি পায়ে শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে খুঁজে বেড়ায় বাদলের হিমুদাকে । লেখকের মৃত্যুর বছর তিনেক পরে , কেউকেউ হিমুকে খুঁজে পেয়েছিল । তবে সেটা রুপালী পর্দায় । মালায়লাম সিনেমা  চার্লিতে । কি এমন ছিলো তাতে ? কেনই বা মনে হলো চার্লি আর কেউ নয় । সে হুমায়ূনের তৈরিকৃত চরিত্র হিমুই। 

মালায়লাম সিনেমার চার্লি 

মালায়লাম সুপারস্টার দুলকার  সালমান ছিলেন রুপালী পর্দার চার্লি । দুলকারের ভেতরে দর্শক চার্লির থেকে হিমুকেই বেশী খুঁজে পেয়েছে। তবে তেসা নামের মেয়েটিকে রূপার সাথে তুলনা না করাই শ্রেয়। হয়তো একারণেই চার্লিকে হিমু সিরিজের নতুন কোন অপ্রকাশিত উপন্যাস বলতেই পাঠক বেশী ভরসা পাবে।
 গল্পের শুরু তেসা নামের মেয়েটিকে কেন্দ্র করে। তেসা নিজেও খানিকটা ভবঘুরে ঘরানার । দুই পায়ে দেখা গেলো দুই ধরনের স্যান্ডেল , জামাকাপড়েও আছে ভিন্নতা । কোন পরিকল্পনা ছাড়াই জীবনকে এগিয়ে নেওয়া যার একমাত্র পরিকল্পনা । এসব শুনে ভাবতে পারেন , এ আবার কেমন ধরণের মেয়ে ! ভিন্নতা আছে বলেই না বিয়ের প্রস্তাব শুনেই বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলো । পালিয়ে গিয়ে কোথায় উঠবে তার কোন ঠিক নেই। অবশ্য শেষমেশ গিয়ে উঠে একটা  পুরোনো  ধাচের বাসায় । বাসার ভেতরে প্রবেশ করেই তো বিরক্তির কোন শেষ নেই। যতসব আজগুবি জিনিসে পরিপূর্ন ঘর ।  কে গোছাবে এই ঘর ! এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই ঘর গোছাতে গিয়ে একটি কমিক বইয়ের সন্ধান মেলে। গল্প কিছুটা এরকম - হ্যাপি নিউ ইয়ারের রাতে এক চোর আসে চুরি করতে ।। কিছুক্ষণ বাগবিতণ্ডার পরে দুইজন মিলে বের হয় একসাথে চুরি করার উদ্দেশ্যে! চুরি করতে গিয়ে যখন ছাদের টালি খুলে , দুজনেই তখন চমকে ওঠে । গল্প শেষ। অসমাপ্ত গল্প । কিন্তু শেষ জানার ইচ্ছাই তেসাকে ব্যাকুল করে তোলে । শুরু হয়  কমিক গল্পের শেষ খোঁজার গল্প । 




 বইয়ের গল্প যে চোরকে কেন্দ্র করে , সেই চোরের সাথে দেখা হয়ে যাই তেসার । চোরের কাছ থেকে জানতে পারে , সেদিন কোন এক তরুণী আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল । কিন্তু সে এখন কোথায় তা জানে না । তাকে নিয়েই শুরু হয় গল্পের স্রষ্টার সাথেসাথে শেষ খোঁজার গল্প। চোরকে সঙ্গে নিয়ে তেসা উপস্থিত হয় সেই মেয়ের বাড়িতে । সেখান থেকে জানতে পারে , মেয়ের নাম কানি। 

এরপরে চার্লি নামের ভবঘুরে যুবক কোথায় কোথায় গিয়েছে, কাদের সাথে সময় কাটিয়েছে খুঁজতে থাকে সে। একের পর এক জায়গায় খুঁজেও দেখা মেলে না । শেষমেশ খবর মেলে সে এসেছে । সেবার একটুর জন্য  দেখা হয় না তার। 

এরপরে খোঁজ মেলে ইয়োথ হোস্টেল নামে একটা শিশু-বৃদ্ধদের আশ্রয়কেন্দ্রের। সেখানেই কানির সাথে দেখা হয় তেসার । উত্তর মেলে সেদিন রাতে কি কি ঘটেছিল আর কেনই বা কানি আত্মহত্যা করতে চেয়েছে । দেখা মেলে কুঞ্জুপা নামের এক বৃদ্ধের যার কাছ থেকে জীবনের পরিপূর্ণ অর্থ বোঝা যায় । তবু দেখা হয় না ভবঘুরে তরুনের। 

শেষমেশ পুরাম উৎসবে তেসার সাথে দেখা হয় ভবঘুরে যুবকের । সেখানেও রহস্যের ছোয়া। তেসা নিজেকে লুকিয়ে অন্য নামে পরিচয় দেয় । পরে দুলকার স্মৃতি হিসাবে ছবি তুলে রাখতে চায় । তবে কিছুক্ষণ পরে ছবিতে দেখা যাই , সেই বিয়ে পালানো তেসাকে । ততক্ষণে আবারো  লোক সমাগমে হারিয়ে গেছে ভবঘুরে মানুষটি । তবে অনুষ্ঠান শুরু হতেই দেখা মেলে তরুণের। আর হাত বাড়িয়ে প্রথমবারের মতো বলে "চার্লি" । 


হিমু ও চার্লির মিল যেখানে:


১ . হিমুর বাবার আদেশ - হিমুকে থাকতে হবে খোলা ময়দানে ।শেষমেশ খোলা ময়দানে না থাকলেও ঘর আটকানোর কোন ব্যবস্থা তার ছিল না । চার্লি সিনেমায় "চার্লি" নামের ভবঘুরে তরুণেরও ঘর আটকানোর কোন  ব্যবস্থা নেই । 

২ . হ্যাপি নিউ ইয়ারের রাতে তার ঘরে চুরি করতে আসে চোর। কিছুক্ষণ বাগবিতণ্ডার পরে দুইজন মিলে বের হয় একসাথে চুরি করার উদ্দেশ্যে! এখানেই হিমুর সাথে পাঠকেরা মিল খুঁজে পাই । আয়না মজিদের মতো মাস্তান কিংবা বিভিন্ন থানার ওসিদের থেকেও সম্মান আদায় করে নিত হুমায়ূনের হিমু চরিত্রটি । 




৩ . হিমুকে ফাতেমা খালা , মাজেদা খালারা সপ্তাধরে খুঁজেও মাঝেমাঝে খুঁজেই পেতো না । মাঝেমাঝে কোথায় যেনো ডুব দিত হিমু । চার্লির ও ডুব দেওয়ার অভ্যাস রয়েছে । মাঝেমাঝে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাই চার্লি । 


৪.  ইয়োথ হোস্টেলের বৃদ্ধদের সাথে সময় কাটানো চার্লির জীবনের অংশ । তাদের আনন্দে রাখা তার দায়িত্ব । কুঞ্জুপা নামের  এক বৃদ্ধ  শৈশবের প্রেম বুকে বয়ে বেড়াচ্ছিল। সেই বৃদ্ধকে সারপ্রাইজ দিতে অন্যরকম এক আয়োজনে মেতে ওঠে   । তার শৈশবের সেই প্রিয়তমাকে নিয়ে হাজির হয়  তাও আবার কুঞ্জপার জন্মদিনেই। হিমুর মধ্যেও এই ব্যাপারটা আছে। হিমু মানুষকে সারপ্রাইজ দিতে ভীষণ পছন্দ করে। দেখা গেলো মিরপুর থেকে ফার্মগেট যেতেই রিকশাওয়ালাকে  থামিয়ে ৫০০ টাকার নোট দিয়ে বলবে এটা আপনার। রিকশাওয়ালা ছলছল চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলবে , আসেন এক কাপ চা খাই । কিংবা "এবং হিমু " তে রুপাকে দিয়ে চাকুরীর ব্যবস্থা করে বদরুল সাহেবকে চমকে দিতে চেয়েছিলেন । ময়ূরাক্ষী তে দাড়ি-গোফ কামানোর কথা বলে বাদলকেও হতভম্ব করে দিয়েছিলেন। এমন করে কতজনকেই তো বিভ্রান্ত করেছে হিমালয়। ইরা-তামান্না-তুরতুরিরা কোন না কোন সময় বিস্ময় প্রকাশ করেছেই । 

৫ . সমুদ্রের মাঝে মরিয়মকে জলপরী দেখাতে নিয়ে যাই চার্লি । মধ্যরাতের সমুদ্র দেখে কতই না অভিভূত হতো মরিয়মরা । আর হিমু রুপালী রাতে ব্যাঙাচিদের মতো বন্ধুদের নিয়ে গাজীপুরের শালবনে পূর্ণিমা দেখতে যেতো। 

৬ . পুরো যাত্রায় চার্লিকে খুঁজতে গিয়ে তার সাথে সম্পর্কের বাধনে  জড়িয়ে পড়ে তেসা । বারবার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা  তৈরী হয়েও তবু দেখা হয় না। ইচ্ছা করেই যে দেখা করছে না , সেটা বোঝা যাই সিনেমার শেষের দিকে যখন কানি চার্লিকে বলে , কেনো লুকাচুরি খেলছো ? প্রতিউত্তরে চার্লি মুচকি হেসে জানাই , সে কোন লুকাচুরি খেলছে না। আর তা থেকেই বোঝা যাই , ইচ্ছা করেই তেসার সাথে এতোদিনেও দেখা করেনি সে । হিমু নিজেও রুপাকে বেশ কয়েকবার নীল শাড়ি পরে বেলকনিতে দাড়াতে বললেও সে কখনো যাইনি । অবশ্য হিমুর সাথে এখানে  একটা পার্থক্য রয়েছে চার্লির । রুপা হলো হিমুর বান্ধবী কিন্তু তেসার সাথে চার্লির কখনোই দেখা হয় নাই ।

একবার পত্রিকায় চার্লির মৃত্যু সংবাদ ছেপেছিল তার বাবা । সেটা দেখে কি বেলজিয়াম আর কি  বেঙ্গালুরু বহু জায়গা থেকে বহু লোক এসে জমা হয়েছিল । হিমুর মৃত্যুতে কি এমন হতো ! লেখক অবশ্য সেটা বুঝে ওঠার সুযোগ করে দেয়নি। কে জানে হয়তো হিমুর মৃত্যুর খবর শুনেও অনেকেই এসে ভিড় জমাতো । তবে লেখকের মৃত্যুর পরে অনেক তরুণই হলুদ পান্জাবী পরে ভিড় জমিয়েছিল ।