বিশ্বের যে নিদর্শনগুলো সবচেয়ে বেশি রহস্যময়, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ইনকা সভ্যতার মানব সৃষ্ট অপরুপ বিষ্ময়কর সৃষ্টি "মাচু পিচু"। আসলে মাচু পিচুর আভিধানিক অর্থ হল প্রাচীন চূড়া। মাচু পিচুর এ রহস্যময় স্থাপনাপুঞ্জ সমুদ্রবক্ষ থেকে প্রায় আট হাজার ফুট ওপরে অবস্থিত। যেখানে শ্বাস নিতে অভ্যস্ত হতেই শরীর অসাড় হয়ে আসে, সেখানে গড়ে উঠেছে এই বিপুল স্থাপনা। কুজকোর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় পাথুরে গ্রামাঞ্চলগুলোর পাশেই এই শহর অবস্থিত। ১৯১১ সালে, জুলাইয়ের ২৪ তারিখ, আমেরিকান পুরাতত্ত্ববিদ হিরাম বিঙ্গাম পেরুর প্রাচীন অধিবাসী ইনকা-দের শহর মাচু পিচু-কে প্রথমবারের মত আবিষ্কার করেন। বর্তমানে এটি বিশ্বের শীর্ষ পর্যটন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে একটি। এটিকে ১৯৮১ সালে পেরুর সংরক্ষিত ঐতিহাসিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ইউনেস্কো ১৯৮৩ সালে এটিকে তাদের বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
মাচু পিচু শহর পেরুতে অবস্থিত। এটি ইনকা সভ্যতার সবচেয়ে আলোচিত নিদর্শন, যাকে ‘ইনকাদের হারানো শহর‘ বলা হয়। আন্দিজ পর্বতমালা পেরুর অংশের দিকে একটি পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত ইনকাদের হারানো শহর মাচু পিচু।  সমুদ্রতল থেকে প্রায় ৮,০০০ ফুট উপরে আন্দেস পর্বতশ্রেণির মধ্যে একটি ছোট পাহাড়ের চূড়ার উপর এই শহর অবস্থিত। এ অঞ্চলেই উপকথার প্রথম সাপা ইনকা মাংকো কাপাক ১২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে কোস্কো রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।


পরবর্তীকালে মাংকো কাপাকের উত্তরসূরিদের অধীনে আন্দেস পর্বতমালার অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীগুলোকে নিজেদের মধ্যে নিয়ে এসে এ রাজ্যটি বিস্তার লাভ করে। ১৪৪২ সালের মধ্যেই রাজা পাচকুতিকের অধীনে ইনকারা তাদের সাম্রাজ্য দূরদুরান্তে বিস্তৃত করে, পাচকুতিক নামের অর্থই হচ্ছে, ‘পৃথিবী কাঁপানো মানুষ’। তিনিই ইনকা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, যা কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের আগে দুই আমেরিকা মহাদেশের সর্ববৃহত্ সাম্রাজ্য ছিল।
ইনকা সাম্রাজ্য প্রে-কলাম্বিয়ান আমেরিকাতে বৃহত্তম সাম্রাজ্য ছিল। এই সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক কেন্দ্র ছিল কোস্কো শহর। পেরুর পাহাড়ি এলাকায় ১৩০০ শতকের দিকে ইনকা সভ্যতার সূচনা হয়। শহরটিতে ১৪০ টি স্থাপনার মধ্যে রয়েছে কিছু মন্দির, পবিত্র স্থান, উদ্যান এবং আবাসিক ভবনসমূহ ।



মাচু পিচুতে রয়েছে ১০০ টিরও বেশি সিঁড়ি যার মধ্যে কিছু কিছু একটি মাত্র গ্রানাইট পাথরের খণ্ড দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এখানে আরও রয়েছে প্রচুর সংখ্যক ঝরনা, যেগুলো পাথর কেটে তৈরি করা ছোট ছোট খালের মাধ্যমে পরস্পর সংযুক্ত এবং এসব মূলত সেচ কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। মাচু পিচুর ইতিহাস থেকে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, এই সেচব্যবস্থা ব্যবহার করে একটি পবিত্র ঝরনা থেকে পানি প্রতিটি বাড়িতে সঞ্চালনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ঝরনাটি ১৪৫০ সালের দিকে নির্মিত হয়, কিন্তু এর এক শ’ বছর পর ইনকা সভ্যতা যখন স্পেন দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন এটি পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে। কয়েক শ’ বছর অজ্ঞাত থাকার পর ১৯১১ সালে হাইরাম বিঙ্গাম (Hiram Bingham) নামে এক মার্কিন ঐতিহাসিক এটিকে আবার সমগ্র বিশ্বের নজরে নিয়ে আসেন।
হিরাম বিঙ্গাম কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো বা খচ্চরের পিঠে চড়ে তার ছোট দল নিয়ে ইনকাদের হারানো শহর খুঁজতে খুঁজতে কুজকো থেকে উরুবাম্বা উপত্যকায় এসে পৌঁছেছিলেন। এই উপত্যকায় এসে তাদের সাথে একজন স্থানীয় কৃষকের দেখা হয়। ঐ কৃষকই সেখানের কাছাকাছি এক পর্বতমালার উপর কিছু ধ্বংসাবশেষ পাওয়ার খবর বিঙ্গামকে দেন। চাষী তাকে স্থানীয় কেচুয়া ভাষায় এই পর্বতমালার নাম বলেছিলেন “মাচু পিচু”।



 পরের দিন-২৪শে জুলাই, বিঙ্গাম এবং তার দল ঠান্ডা ও ঝড়ো আবহাওয়ার সাথে যুদ্ধ করে সেই পাহাড়ের দিকে গমণ করেন। পথে তার সাথে একদল স্থানীয় চাষীদের দেখা হয়, এবং তারাই তাকে বাকি পথ দেখিয়েছিলেন। একজন ১১ বছর বয়সী ছেলের নেতৃত্বে বিঙ্গাম মাচু পিচুর চূড়ায় পৌঁছাতে সক্ষম হন, এবং মাচু পিচুর প্রবেশদ্বারের অঙ্কিত পাথর সনাক্ত করেন।
মাচু পিচু নির্মিত হয়েছিল প্রায় ১৪৫০ সালের দিকে। তবে তা খুব বেশি দিন ভোগ করতে পারেনি ইনকারা। ১০০ বছর পরেই স্প্যানিশরা ইনকা সভ্যতা আক্রমণ করে। এবং ধ্বংস করে ফেলে তাদের বেশির ভাগ শহর। কিন্তু মাচু পিচু শহরটি গুপ্ত স্থানে হওয়ায় তারা এটি খুঁজেই পায়নি! এদিকে মানুষের উপস্থিতি না থাকার কারণে শহরটি ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। কয়েকশ বছর ধরে তো মানুষ এই ঐতিহাসিক শহরটিকে খুঁজেই পায়নি। অন্য একটি মতবাদ অনুসারে মাচু পিচু একটি ইনকা লিয়াক্তা বা এমন একটি উপনিবেশ যা বিজিত অঞ্চল সমূহের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হত। আবার কেউ কেউ মনে করেন এটি একটি জেলখানা হিসাবে ভয়ংকর অপরাধীদের রাখার জন্য নির্মিত হয়েছিল।


বিঙাম অনেকটা ঘটনা চক্রেই মাচু পিচুর উদ্ঘাটন করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি ইনকা শহর বিতকোসের সন্ধান করছিলেন, এটি পেরুতে স্পেনীয়দের আক্রমণের বিরুদ্ধে সর্বশেষ ইনকা প্রতিরোধের স্থান এবং ইনকাদের শেষ আশ্রয়স্থল ছিল। বেশ কয়েক বছরের ভ্রমণ ও অনুসন্ধানের কেচুয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা বিঙামকে মাচু পিচু শহরে নিয়ে যায়। এই সম্প্রদায় মাচু পিচুতে ইনকাদের নির্মিত স্থাপনাগুলোয় থাকত। কিছু পরিবার ১৯১১ সালে শহরটি আবিষ্কারের সময় পর্যন্ত সেখানে বসবাস করত, যদিও নগরীর আদি বাসিন্দাদের অধিকাংশই শহর তৈরির এক শ বছরের ভেতর মারা যায়। সে সময় মাচু পিচুতে কিছু মমি (বিশেষতঃ মহিলাদের) পাওয়া যায়। বিঙাম সেখানে বেশ কয়েকবার ভ্রমণ করেন এবং ১৯১৫ সাল পর্যন্ত সেখানে খনন কাজ পরিচালনা করেন। তিনি তার জীবদ্দশায় মাচু পিচুর আবিষ্কার নিয়ে বেশ কিছু বই লিখেছেন।
মাচু পিচুকে ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণায় মাচু পিচুকে বর্ণনা করা হয়েছে ধ্রুপদী বাস্তুকলার নিদর্শন ও ইনকা সভ্যতার অনন্য স্বাক্ষর হিসেবে। ২০০৭ সালের ৭ই জুলাই New Open World Corporation কর্তৃক আয়োজিত প্রতিযোগিতায় মাচু পিচু বিশ্বের সাতটি নতুন বিস্ময়ের একটি নির্বাচিত হয়।