ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকে সবাই। কিন্তু ইতিহাসের মহানায়ক কি সবাই হয়! কেউকেউ তো পার্শ্ব নায়ক থেকে যাই। মাহমুদুল্লাহ কি তেমন একজন নয়? লোকে তাকে ভালোবেসে কয়, সাইলেন্ট কিলার। যে কিনা সাইলেন্টলি সব পেইন কিল করে। তিনি নিজেই একবার বলেছিলেন, সাকিব-তামিম-মুশফিকরা ম্যাচ উইনার! আমি যতটুকু পারবো অবদান রাখবো।



১ .নিদহাসের ছক্কা

কী উত্তেজনা আর রোমাঞ্চই না ছড়াল কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে। ১৬ মার্চ সেমিফাইনালে রূপ নেওয়া সেই ম্যাচ মাঠে লড়াইয়ে ছাপিয়ে আলোচনায় এল নানা ঘটনার ঘনঘটায়।

শেষ ওভারে জয়ের জন্য প্রয়োজন  ১২ রান৷ প্রথম দুই বলে রান হয়নি, দ্বিতীয় বলে আবার রান আউট মুস্তাফিজ৷ তখনই ম্যাচে ছড়ালো অন্য উত্তেজনা।

শেষ ওভারের প্রথম বলটি ছিল বাউন্সার৷ পরের বলটি আবারো বাউন্সার৷  দ্বিতীয় বাউন্সারের কারণে লেগ আম্পায়ার সংকেত দেন নো বলের৷ কিন্তু লঙ্কানদের প্রতিবাদের মুখে আবার নো-বল তুলে নেন আম্পায়ার৷


রেশারেশির শুরু সেখানেই। মাঠের বাইরে চতুর্থ আম্পায়ারের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হন সাকিব আল হাসান। প্রতিবাদী অধিনায়ক মাঠ থেকে চলে আসতে বলেন ব্যাটসম্যানদের৷ শেষ মুহূর্তে ব্যাটসম্যানদের থামান ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ৷ মেনে নেন টাইগাররা৷
৪ বলে তখন দরকার ১২ রান৷ মাহমুদউল্লাহর বাউন্ডারিতে নতুন আশা৷ পরের বলে দুই৷ দুই বলে যখন প্রয়োজন ৬ রান৷ তখনই মাহমুদউল্লাহর অবিস্মরণীয় ফ্লিকে ছক্কা৷ এবং সেই সুবাদে বাংলাদেশ ফাইনালে৷

তামিম ইকবাল এর লাইভ শোতে এসে মাহমুদুল্লাহ বলেছেন, নিদহাস ট্রফির ইনিংসটি তাকে সব থেকে বেশী প্রশান্তি এনে দিছে।


২ . চ্যাম্পিয়নস ট্রফির অভাবনীয় জয়!

নিউজিল্যান্ডের সাথে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেই ম্যাচটা বাংলাদেশের জন্য অঘোষিত কোয়ার্টার ফাইনাল। জিতলে সেমির আশা বেঁচে থাকবে তবে তাকিয়ে থাকতে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের দিকে। নিউজিল্যান্ডের সাথে ২৬৫ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে সাউদির পেসতান্ডবে টপ অর্ডার লন্ডভন্ড। ৩৩ রানেই নেই চার উইকেট। এরপরে ক্রিজে আসেন মাহমুদুল্লা। সাকিবের সাথে গড়ে তোলেন ২২৪ রানের পার্টনারশিপ। বাংলাদেশকে ডু অর ডাই ম্যাচে জয় এনে দেন পাঁচ উইকেটের। আট চার আর চার ছয়ের দেখা মেলে সেঞ্চুরির। তবে এ ম্যাচেও থেকে যান পার্শ্বনায়ক। ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরষ্কার ওঠে সাকিবের হাতে।


৩ . প্রথম বাংলাদেশী হিসাবে ওয়াল্ড কাপ সেঞ্চুরি 

২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড-বাংলাদেশ ম্যাচ! যে দল জিতবে আপাতত তাদের স্বপ্ন বেঁচে থাকবে। টসে জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটে পাঠান ইংলিশ ক্যাপ্টেন আইরিশ ওইন মরগান। মাশরাফী টসে জিতলে ব্যাটই নিতেন। তবে সে আশার সমাপ্তি হয়েছিল শুরুর ধাক্কা। আট রানেই নেই দুই ওপেনার। এর পরে সৌম্যের সাথে গড়েন ৮৬ রানের গুরুত্বপূর্ণ একটা জুটি। তবে ৯৯ রানের মাথায় সাকিব প্যাভিলিয়নে ফিরলে আবারো বিপদে বাংলাদেশ। সেখান থেকে দুই ভাইরা মিলে গড়েন ১৪১ রানের একটা জুটি। সেই পথেই মাহমুদুল্লাহ পেয়ে যান সেঞ্চুরি। রিয়াদের সেঞ্চুরিটি ছিল তার ক্যারিয়ারের প্রথম শতক ও বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে বিশ্বকাপে করা প্রথম শতক।

সেই শতক আর মুশফিকের ৮৯ মিলে বাংলাদেশ পেয়ে যাই  ২৭৫। পরে রুবেলের আগুন ঝরানো এক স্পেলে বাংলাদেশ জয় পাই ১৫ রানে।

মজার বিষয় কি জানেন? ম্যান অফ দ্যা ম্যাচের পুরষ্কার উঠেছিল মাহমুদুল্লাহর হাতেই। তবু সমর্থকেরা বেশী মনে রেখেছে রুবেলের স্পেলটাকে। মাহমুদুল্লাহ সমর্থক মনে রয়ে গেলেন সেই পার্শ্ব নায়ক।


৪ . এশিয়া কাপ ২০১৬ এর অঘোষিত সেমিফাইনাল

সেবার  এশিয়া কাপে পাকিস্তান-বাংলাদেশের মধ্যকার ম্যাচটি রুপ নিয়েছে অঘোষিত সেমিফাইনালে। যে জিতবে সে খেলবে ভারতের বিপক্ষের ফাইনাল।

টসে জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান কাপ্তান আফ্রিদি। তাসকিন-আলামিনদের বোলিংয়ের সামনে তেমন সুবিধা করতে পারেনি পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানরা। ২০ ওভারে করতে পারে মাত্র ১২৯।

তবে আমির-ইরফানদের বোলিং দৃঢ়তায় ১২৯ রানই মনে হয় পাহাড়সম। সৌম্য সরকার অন্যপ্রান্তের সহযোদ্ধাদের যেতে আসতে দেখতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন , সেই সঙ্গে নিজে খেললেন ওয়ানডে  মেজাজের ইনিংস।

টার্গেট তখন পাহাড়সম মনে হচ্ছে। আমিরের তখনো দুই ওভার বাকি। তখনি প্রেক্ষাপটে মাহমুদুল্লাহ। খেললেন ১৫ বলে ২২ রানের ছোটখাটো  এক ক্যামিও ইনিংস। মাশনাফীকে সঙ্গে করলেন তরী ভেড়ালেন ফাইনালের বন্দরে।  কিন্তু তিনি হয়ে রইলেন নায়কের ভাই!

৫ .  রঙিন অভিষেকই সাইড রোলে আবির্ভূত!

২০০৯ সালের কথা! বোর্ডের সাথে ঝামেলায় আনকোরা ধাচের ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল খেলতে নেমেছে বাংলাদেশের বিপক্ষে। বাংলাদেশের হয়ে অভিষিক্ত হয়েছেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ।

প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ অল আউট ২৩৮ রানে। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে থামাতে পারলো ৩০৭ রানে। তার অবদান কিছুটা নবাগত  মাহমুদুল্লাহর। ৫৯ রানে নিয়েছেন ৩ উইকেট।


দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ ঘুরে দাড়ালো তামিমের ব্যাটে। তামিম করলেন ১২৮ আর বাংলাদেশ ৩৪৫। জিততে হলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রয়োজন ২৭৬। প্রেক্ষাপটে সেই মাহমুদুল্লাহ। ৫১ রানে পেলেন ৫ উইকেট। কিন্তু থাকলেন সেই পার্শ্ব নায়ক হয়েই। ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ তামিম ইকবাল।


বছর কয়েক আগে পার্শ্ব নায়ক হয়ে থাকতে চাননি বলেই প্যারিসে পাড়ি জমান নেইমার। কিছুদিন আগে এমবাপ্পে বলেছেন, হতে চান দলের মেইন ম্যান। যদিও ব্যাপারটা ফুটবলের। তবুও কেউ একজন পার্শ্ব নায়কের চরিত্রে থাকুক না। সেটা না হয় মাহমুদুল্লাহই হলো।

পুনশ্চ : বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের সাথে পরের ম্যাচেই আবারও গড়েছিলেন ইতিহাস, এবার বাংলাদেশের প্রথম (২০১৯ বিশ্বকাপের সাকিব কীর্তির আগ পর্যন্ত একমাত্র) ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপে টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি করার কীর্তি গড়লেন।