সারা দুনিয়ায় সোনালি দুয়ার নামে পরিচিত, যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো শহরের গোল্ডেন গেট সেতু। সানফ্রান্সিসকোর ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ও এ ব্রিজ বিখ্যাত। যুক্তরাষ্ট্রের সোসাইটি অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মতে, আধুনিক বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি হলো দ্য গোল্ডেন গেট ব্রিজ। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি তোলা স্থাপনার আলোকচিত্রের মধ্যে অন্যতম এই গোল্ডেন গেট ব্রিজ। তবে পরিচিতি ও বিখ্যাত হওয়ার পেছনে আরোও একটি বিশেষ লোমহর্ষক কারণ রয়েছে। বিভিন্ন জরিপের ফল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে আত্মহত্যার স্থান হিসেবে এক নম্বর স্থানটি দখল করে আছে সানফ্রান্সিসকোর ঝুলন্ত এ সেতুটি। যার কারনে এটিকে আত্মহত্যা ব্রিজও বলা হয়ে থাকে। ব্রিজটি নির্মিত হওয়ার পর থেকে লাফ দিয়ে ১৪০০ এর বেশি মানুষ আত্নহত্যা করেছে সেখানে।
১৯৩৭ সাল, ২৮ মে। এই দিনেই ব্রিজটি সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। উন্মুক্ত করার পর ওই দিনেই প্রায় ২০০০ মানুষ হেটে ব্রিজটি পাড় হয়। তখন এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু আর দীর্ঘ ঝুলন্ত ব্রিজ। ওই সময়ের প্রযুক্তি দিয়ে এই ব্রিজ নির্মাণ অকল্পনীয় ঠেকলেও, মানুষ কিন্তু ঠিকই তৈরি করেছিল সেই ব্রিজ। দুই পাশের দুই স্থলভূমির মাঝখানে ভেদ করে প্রশান্ত মহাসাগরের জলরাশি প্রবেশ করেছে এখানকার সানফ্রান্সিসকো বে এরিয়াতে। প্রকৃতির সেই অপূর্ব প্রবেশপথেরই মানুষের দেওয়া নাম গোল্ডেন গেট।
১৯১৬ সালে ব্রিজটির ভিত্তিপ্রস্তর করা হয়। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে এই সেতুটির প্রতি মনোযোগ দিতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংশি্লষ্ট বিভাগ সেতুটি নির্মাণের অনুমতি দেয়। নকশায় সেতুটির প্রধান স্তম্ভটি ৪০০২ ফুট করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয় ৫ জানুয়ারি ১৯৩৩ সালে। সেতুটি নির্মাণে খরচ হয়েছিল ২৭ থেকে ৩৫ মিলিয়ন ডলার। তত্কালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভল্টে উদ্বোধন করেন।
সেতুটির দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৭ কিলোমিটার আর প্রস্থ ২৭ দশমিক ৪০ মিটার (৯০ ফুট)। ছয় লেন-বিশষ্টি এই সেতুটি দিয়ে দৈনিক এক লাখ ১৮ হাজারেরও বেশি যানবাহন চলাচল করে।
আত্মহত্যার জন্য গোল্ডেন গেট সেতুই কেন বেশি নির্বাচিত?
সান ফ্রান্সিসকো এর গোল্ডেন গেট সেতুকে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় আত্মহত্যার স্থান হিসাবে ধরা হয়। কিছু উৎস অনুযায়ী, গড়ে প্রতি দুই সপ্তাহে এখানে একজন আত্মহত্যা করে। সবচেয়ে খারাপ বছর ছিল ১৯৯৫, যখন ৪৫ জন আত্মঘাতী ছিল। তবুও বিপুল সংখ্যক লোক শেষ মুহূর্তে ঝাঁপ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০৬ সালে, ২২০ ফুট (৬৭ মিটার) লিপ তৈরি করার আগে ৭০ জন আত্মঘাতী মানুষকে সেতুটি থেকে উদ্ধার করে নেওয়া হয়েছিল। গোল্ডেন গেট সেতু থেকে আত্মহত্যার পদ্ধতি বেশ কার্যকরী। ২৪৫ ফুট (৭৫ মি) থেকে ৭৫ মাইল গতিতে (১২০ কিঃ মিঃ / ঘণ্টায়) পানিতে পড়ে । যা একটি দ্রুতগতির ট্রাকের সাথে ধাক্কা লাগার সমান। তাই এখান থেকে লাফিয়ে পড়া ব্যাক্তিদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৫% এরও কম। তবে ধারণা করা হয় মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি। কারণ অনেক সময় লাফানোর পরে অনেকের লাশ কখনও পাওয়া যায়নি।চার বছরে মোট ১১ শ্রমিকের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তৈরি হয় ঐতিহাসিক ব্রিজটি। স্ট্রসের উদ্ভাবিত একটি অস্থাবর নিরাপত্তা জাল নির্মাণকালীন সময়ে ১৯ জন শ্রমিকের নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে। তবে সুরক্ষা জালটি নির্মাণ কাজের শেষ মুহূর্তে এসে ১৭ ফেব্রুয়ারী, ১৯৩৭ সালে ব্যর্থ হয়, এক দূর্ঘটনায় ১৩ জন শ্রমিক পড়ে যায়। যাদের মধ্যে ১০ জনই মারা যান। ২০১৩ সালের একটি অনুমানপূর্বক হিসাব অনুযায়ী, ৩৪ জন লাফিয়ে যাওয়ার পরও বেঁচে গেছেন। মূলত যাদের মৃত্যু হয়, অভ্যন্তরীণ আঘাত থেকে তাৎক্ষণিকভাবে মারা যায় বা হাইপোথার্মিয়াতে বা ডুবে মারা যায়। ২০১৩ সালে, ১১৮ জন সম্ভাব্য আত্মহত্যা চেষ্টাকারীকে তাদের প্রচেষ্টা থেকে নামিয়ে আনা হয়। আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও সেগুলিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আসছেন আত্মহত্যাকারীরা। তাই সানফ্রান্সিসকোর সোনালি দুয়ার মৃত্যুর দুয়ার হিসেবে রয়ে গেছে।
সেতুটি চালু হওয়ার তিন মাসের মাথায় প্রথম ওবার নামের একব্যাক্তি আত্মহত্যা করেন। সত্য এই যে গোল্ডেন গেট সেতুতে আত্মহত্যা এখন এত সহজ হয়ে উঠেছে যে, বৃহত্তর প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। একসময় আত্মহত্যার যে সংখ্যা গণনা করার প্রচলন ছিল, সেটি বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। গোল্ডেন গেটে প্রবেশের পথে আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিভিন্ন সাইনবোর্ড ব্যাবহার করেছে কর্তৃপক্ষ।
0 Comments
Post a Comment