হ্যালীর ধুমকেতু পৃথিবীর আকাশে দেখা যাই ৭৬ বছর পরপর। সাকিব আল হাসান কি বাংলাদেশের ক্রিকেটে হ্যালীর ধুমকেতু নয়! তার আগমন তো বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য হ্যালীর ধুমকেতুর থেকে কম কিছু নয়। অবশ্য ভারতীয় কিংবদন্তী সৌরভ গাঙ্গুলীর মতে, " শচীন টেন্ডুলকার কিংবা জ্যাক ক্যালিসের মত খেলোয়াড় ১০০ বছরে একবার জন্ম নেয়, আর সাকিব আল হাসানের মত খেলোয়াড় দশ হাজার বছরে একবার জন্ম নেয়। " সে অর্থে সাকিব শুধুমাত্র বাংলাদেশ ক্রিকেটের নয়, বরং পুরো ক্রিকেট বিশ্বের পোস্টার বয়। সেটা সাকিবকে বলাই যাই, সেই ২০০৯ সাল থেকে ওয়ানডেতে অলরাউন্ডার তালিকার শীর্ষে, এরপরে একে একে টেস্ট আর টি-টুয়েন্টিতে শীর্ষে ছিলেন। ছিলেন একমাত্র ক্রিকেটার হিসাবে একইসাথে তিন ফরমেটের শীর্ষ অলরাউন্ডার, আগের দশকের শুরুর দিনগুলোতে ছিলেন ওয়ানডে ক্রিকেটের নাম্বার ওয়ান বোলার। এতোকিছুর পরেও কি তাকে বিশ্ব ক্রিকেটের কিংবদন্তি বলা যাবে?

বিশ্ব ক্রিকেটের কিংবদন্তি হতে হলে বিশ্ব স্টেজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে হয়। সেটা কে বা না জানে! বড় ম্যাচে রানের ফুলঝুরি ছোটাতে হবে কিংবা বোলিং ঘূর্ণিতে তছনছ করে দিতে হবে বিরুদ্ধ দলের ব্যাটিং স্তম্ভদের। সেসবের কিছু কি সাকিবের মাঝে ছিল। পরিসংখ্যান দেখলে হয়তো বিশ্ব ক্রিকেটের অনেকেই সাদামাটা মনে করবে। বিশ্বকাপ ২০১৯ এর পূর্বে সাকিব একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে করে ১৯৮ ম্যাচে ৫৭১৭ রান। গড় ৩৫.৫০ এর আশেপাশে সেই সাথে উইকেট আছে ২৪৯ টি। এতোদিন বিশ্বকাপ খেলেছেন ৩ টা, এশিয়া কাপ খেলেছেন কয়েকটা, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি-২০১৭ ও খেলেছেন । বলার মতো পারফরমেন্স শুধু নিউজিল্যান্ডের সাথে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ম্যাচটা। তাইতো নাসের হুসাইন বলে ফেলেছিলেন,
"He is a superster of Bangladesh, playing like a superstar of world today." 
২০১২ এর এশিয়া কাপে যদিও সিরিজ সেরা হয়েছিলেন তবু বিশ্ব ক্রিকেটের মোড়লদের চোখে পড়েননি তেমন একটা। অবশ্য সময়ের প্রয়োজনে হলেও সাকিবকে বড় স্টেজে পারফর্ম করতেই হতো। সাকিবের সাথে যাদের তুলনা করা হয়, তারা সকলেই কোন না কোন স্টেজে পরীক্ষিত সেনা। ইমরান খান, কপিল দেব, ল্যান্স ক্লুজনার, যুবরাজ সিং, ইয়ান বোথাম, জ্যাক ক্যালিস, সনাৎ জয়সুরিয়া - কখনো না কখনো বড় স্টেজে পারফর্ম করেছে এদের সবাই। অথচ তখনো সাকিব শুধুমাত্র বাংলাদেশীদের মুখেমুখে আর আইসিসির প্রকাশিত তালিকাতেই শীর্ষে। বিশ্বক্রিকেটের স্বীকৃতি তখনো বাকি।

বিশ্বকাপ-২০১৯ ও একজন সাকিব আল হাসান

সাকিব প্রথমবারের মতো নিজের সম্পর্কে বুঝতে পারলেন বোধহয় ২০১৭ সালে কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে আইপিএল খেলতে গিয়ে। সেবার আইসিসি প্রকাশিত তালিকায় তাকে দেখাচ্ছে টি-টুয়েন্টির সেরা অলরাউন্ডার অথচ কলকাতার হয়ে সুযোগ পেলেন মাত্র একটা ম্যাচে। পরের মৌসুমে সানরাইজ হায়দ্রাবাদের হয়ে খেললেন সব কয়টি ম্যাচ। কিন্তু ২০১৯ সালে আবারো সেই বেঞ্চ ওয়ার্মার। এবার সময়টা কাজে লাগান। দেশ থেকে ডেকে নেন প্রিয় শিক্ষক সালাউদ্দীনকে। সময় কাটানো শুরু করলেন জীমনেশিয়ামে। ওজন কমালেন আট কেজির মতো।

এরপরেই দেশজুড়ে শুরু হলো সাকিবকে নিয়ে সমালোচনা। কেন তিনি দেশে এসে প্রাকটিস সেশনে যোগ দিচ্ছেন না, কেনই বা ফটো সেশনে আসলেন না! অথচ সাকিব তখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মহোৎসবে মেতে ওঠার।


সাউথ আফ্রিকা বনাম বাংলাদেশ

৭৫ রানে দুই উইকেট হারিয়েছে বাংলাদেশ। এবার লড়াইটা সাকিব-মুশফিকের। আফ্রিকার মরণ পেস অস্ত্রের সাথে ইমরান তাহিরের ঘূর্ণি আটকাতে শুরুর দিকে কিছুটা বিভ্রান্ত সাকিব-মুশফিক। ওভালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সাকিব-মুশফিক বাংলাদেশের হয়ে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ১৪২ রানের জুটি গড়েন। সাকিব ফিরে যান ইমরান তাহিরের বলে ৭৫ করে। এর পরপরই মুশফিক ফেরেন ৭৮ এ। শেষ দিকে রিয়াদ-মোসাদ্দেকের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ পেয়ে যাই ৩৩০ রানের বড়ো পুঁজি। বোলিং-ফিল্ডিংয়েও অনবদ্য ছিলেন সাকিব। দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৩০৯ রানে আটকাতে এইডেন মার্করামের গুরুত্বপূর্ণ উইকেট নেন আর সেইসাথে ফেলুকাইয়াওর দূর্দান্ত ক্যাচও লুফে নেন। ম্যাচসেরার পুরুষ্কার ও জেতে সাকিব আল হাসান।


বাংলাদেশ বনাম নিউজিল্যান্ড 

কেন উইলিয়ামসনের সহজ রান আউটের সুযোগ মুশফিক মিস না করলে হয়তো টানা দ্বিতীয় জয়ের দেখা পেয়ে যেতো বাংলাদেশ। তবে এ ম্যাচেও অনবদ্য ছিলেন সাকিব। ব্যাট হাতে খেলেন ৬৪ রানের ইনিংস। বল হাতে নিউজিল্যান্ডের ইনিংসের শুরুতে গাপটিল-মুরনোর উইকেট তুলে নেন। বাংলাদেশ ম্যাচ হেরে যাই দুই উইকেটে।


ইংল্যান্ড বনাম বাংলাদেশ 

নিজেদের বোলিংই এ ম্যাচে বাংলাদেশকে কুয়াতে ডোবাই। বল হাতে কেউই জ্বলে উঠতে পারেনি জেসন রয় - বেন স্টোক্সের সামনে। ইংল্যান্ডের স্কোরকার্ডে ৩৮৬ রানের পর্বতসম রান। মনে হচ্ছিলো দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নামার আগেই হেরে গেছে বাংলাদেশ। তবু হাল ধরলেন সেই সাকিব। খেললেন ১২০ রানের একটা ইনিংস । তবে দলের অন্যদের ব্যর্থতায় হেরে গেলো বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ বনাম উইন্ডিজ

১০ ওভার শেষে ১ উইকেটে ৩২ রান তোলা ওয়েস্ট ইন্ডিজ বাংলাদেশকে জয়ের জন্য শেষ পর্যন্ত ৩২২ রানের লক্ষ্য দাড় করায়। বল হাতে মুস্তাফিজ-সাইফুদ্দিনের ৩ উইকেটের সাথে সাকিব নেয় ২ উইকেট। ৩২২ এর লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ১৩৩ রানে ৩ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। জিততে তখনো ১৮৯ রানের প্রয়োজন। কিন্তু সুপারম্যান সাকিবের অবিচ্ছেদ্য শতকের সাথে পার্শ্ব নায়ক লিটন দাসের অপরাজিত ৯৪ বাংলাদেশকে এনে দেয়ে সাত উইকেটের জয়। আবারো সাকিব ম্যান অফ দা ম্যাচ।


বাংলাদেশ বনাম অস্ট্রেলিয়া 

আবারো বোলিং ব্যর্থতায় ডোবে বাংলাদেশ। ওয়ার্নার-খাজাদের সামনে কোন বোলারই নিজেকে মেলে ধরতে পারেনি। ৩৮২ রানের পাহাড়সম টার্গেট বাংলাদেশের সামনে। শুরু থেকে ব্যাটিংয়ে ভালোই জবাব দিচ্ছিলো বাংলাদেশ। তবে আগের ম্যাচগুলো যারা দেখেছে, সে হিসাবে সাকিব ব্যর্থই। ৪১ এ ফিরে যাই সাকিব। এদিন মুশফিকের ব্যাটে ছন্দ খুঁজছিল বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ। ৪০ ওভার পর্যন্ত ম্যাচেও ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু পাওয়ার হিটারের অভাবে শেষমেশ ৪৮ রানে হেরে যাই বাংলাদেশ। মুশফিকের সেঞ্চুরি হয়ে থাকে শুধুমাত্র সান্ত্বনার বাণী।
"অকশন ফর অ্যাকশন " নামে এক অনুষ্ঠানে সাকিব বলেন, এ ম্যাচের ৯ রানের আক্ষেপ তাকে এখনো কাঁদাই।


বাংলাদেশ বনাম আফগনিস্তান

আফগানিস্তানের স্পিন আক্রমণের কথা মাথায় রেখেই উদ্বোধনী জুটিতে একটু পরিবর্তন আনে বাংলাদেশ। ডান হাতি-বাঁহাতি সমন্বয় করতে সৌম্য সরকারকে চারে নামিয়ে তামিম ইকবালের সঙ্গে ওপেনিং জুটিতে পাঠানো হয় লিটন দাসকে। ২৩ রানের বেশি অবশ্য টেকেনি জুটিটা। মুজিব উর রেহমানকে শর্ট কাভার দিয়ে ড্রাইভ করতে গিয়েছিলেন লিটন।

ম্যাচটা হয় লো স্কোরিং। বাংলাদেশ করতে পারে সাত উইকেটে ২৬২ আর সাকিব ৫১। এ ম্যাচেই পূর্ণ করলেন ক্রিকেট বিশ্বকাপে প্রথম বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসেবে ১০০০ রান।

মূলত বল হাতেই ম্যাচের চাকা ঘেরালেন সাকিব। নিলেন ২৯ রানে ৫ উইকেট। বাংলাদেশ ম্যাচ জিতলো ৬২ রানে। সাকিব বাংলাদেশের জেতা তিন ম্যাচেই ম্যান অফ দা ম্যাচ। এ ম্যাচেই ভারতের যুবরাজ সিংয়ের পরে বিশ্বকাপে একই ম্যাচে ৫ উইকেট আর পঞ্চাশের ডাবল রেকর্ডের অংশীদার হন সাকিব।


ভারত বনাম বাংলাদেশ

পুরো টুর্নামেন্টে বোলিং-ফিল্ডিং ব্যর্থতায় ভোগে বাংলাদেশ। এ ম্যাচও তার বাইরে নয়। শুরুতেই রহিত শর্মার ক্যাচ ছেড়ে দেয় তামিম। ইনিংস শেষে রোহিত করে ১০৪। ওপেনিং জুটতে আসে ১৮০। তবে ডেথ ওভারে মুস্তাফিজ নিজেকে মেলে ধরাতে ৩১৪ এর বেশী করতে পারেনি ইন্ডিয়া।

ব্যাটিংয়ে আবারো ছন্দপতন। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে বাংলাদেশ। সাকিব কিছুটা চেষ্টা অবশ্য করেছিল তবে ব্যক্তিগত ৬৬ তেই কাঁটা পড়েন সাকিব। তাই শেষের দিকে সাইফুদ্দিনের পঞ্চাশ শুধুমাত্র হারের ব্যবধান কমিয়েছে।


বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তান 

ইমামুল হকের সেঞ্চুরি আর বাবর আজমের নড়বড়ে নব্বইয়ে পাকিস্তান পেয়ে যাই ৩১৫ রানের পুঁজি। বোলিং-ফিল্ডিংয়ে আরো একবার ব্যর্থ বাংলাদেশ। এবার ব্যর্থ ব্যাটিংয়েও। এক শাহীন আফ্রিদির সামনেই দাড়াতে পারেনি বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যান। সাকিব শাহীনের বলে আউট হওয়ার আগে করেন ৬৪। বাংলাদেশ হারে ৯৪ রানে।


সাকিবময় বিশ্বকাপ রেকর্ডসমূহ

১. প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপে ১০০০ রান করার রেকর্ড গড়েছিলেন সাকিব।
২. বিশ্বকাপে ১০০০ রান ও ৩০ টি উইকেট নেয়া একমাত্র ক্রিকেটার এখন সাকিব আল হাসান।
৩. প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে এক বিশ্বকাপে গ্রুপপর্বে ৬০০ রান
৪. বিশ্বকাপের এক আসরে পঞ্চম সর্বোচ্চ রান
৫. এক বিশ্বকাপে ৪০০ / ৫০০ / ৬০০ রান ও ১০ টি উইকেট নেয়া একমাত্র খেলোয়াড় সাকিব।
৬. এক বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি করা ও পাঁচ উইকেট নেয়া তৃতীয় ক্রিকেটার সাকিব। এর আগে এই কাজটি করেছিল কপিল দেব ও যুবরাজ সিং।
৭. বিশ্বকাপে এক ম্যাচে ৫০ রান ও ৫ উইকেট তুলে নেয়া দ্বিতীয় ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান।
৮. এক আসরে সবচেয়ে বেশী ৫০+ ইনিংস সাতটি। সঙ্গে আছেন শচীন।
৯.বিশ্বকাপের এক আসরে সবচেয়ে বেশী গড় সাকিবের। গড় ৮৬.৫৭।
বিশ্বকাপে সাকিবের পারফরমেন্সে অভিভূত পুরো বিশ্ব। এ বিশ্বকাপের মাঝেই প্রশ্ন উঠেছে, সাকিব কি তাহলে সকলকে ছাড়িয়ে গেছে। আপাতত পরিসংখ্যান তার পক্ষেই। বিশ্বকাপ ইতিহাসের এক আসরের সেরা পারফর্মার তাকে বলাও যাই। ১১৪৬ রান করে বিশ্বকাপ ইতিহাসের রান সংগ্রাহকের তালিকাতে আছেন ৯ এ। ৩৪ উইকেট নিয়ে আছেন সে তালিকায় ১৫ তে। সাকিব খেলতে পারেন আরো দুটি বিশ্বকাপ। কে জানেন, কোন চূড়ায় উঠবেন?

বিশ্বকাপের মাঝপথেই সুনীল যোশি, সাকিবকে কিংবদন্তী বলে দিলেন।হার্সেল গিবস বললেন, সাকিবকে সবাই টপক্লাস অলরাউন্ডার বলে জানে, এবার জানছে তার ব্যাটিং পারদর্শিতা। প্রতি ম্যাচের পরেই টুইটার মেতে উঠতো সাকিব স্তুতিতে। ওয়াসিম আক্রাম থেকে কপিল দেব সবাই মেতেছেন সাকিব বন্দনাতে।

২০১৯ ওয়াল্ড কাপ সবাই ভুলে যাবে। একজন সাকিবকে মনে রাখবে সবাই। কেমন করে সাকিব থেকে হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তী সাকিব। চাঁদের কলঙ্কের মতো সাকিবেরও কলঙ্ক আছে। দলকে তুলতে পারেননি শেষ চারে।

৯৬ এ ল্যান্স ক্লুজনার পেরেছিলেন আফ্রিকাকে শেষ চারে তুলতে, ১১ এর যুবরাজ পেরেছিলেন বিশ্বজয় করতে। হায়! আফসোস, সাকিব পারেননি। সে ব্যর্থতা সাকিবের নাকি দলের বাকি সবার?


(পুনশ্চ: বাংলাদেশ-শ্রীলংকার মধ্যকার ম্যাচটি বৃষ্টির কারণে পরিত্যক্ত হয়)