রিকার্ডো কাক : এসি মিলানের অঘোষিত রাজা

কেউ কেউ তাকে খেয়ালী রাজা বলে ডাকেন, কেউ আবার অভাগা রাজপুত্র। কেউ কেউ আবার মনে করেন, তিনি হলেন এমন এক  রাজা, যার "ভক্ত" নামের বিস্তৃত এক সম্রাজ্য ছিল, ফুটবল নামের "রানীতে" ও মন হারিয়েছিলেন। কিন্তু "চোট " নামের নির্লিপ্ত এক শত্রুর প্রতিটা আচর অচিরেই শেষ করে দিলো তাকে। দিনশেষে ফুটবলের সম্ভব্য সকল ট্রফি জিতেও কেনো যেনো, তার নাম সেরাদের প্রথম দিকে আসেনা। কিন্তু এসবের তিনি থোড়াই কেয়ার করেন। তিনি হলেন রিকার্ডো কাকা।

পুরো নাম রিকার্ডো আইজেকসন দস সঁন্তোস লেইতি। এ নামে তাকে বিশ্বের ৯০ শতাংশ মানুষই হয়তো চেনে না। ছোট ভাই ডিয়াগো  "রিকার্ডো" নামের উচ্চারণ করতে পারতো না। তাই সে  বড়ভাইকে ছোট করে ডাকে "কাকা"। পরবর্তীতে বিশ্ব তাকে চেনে এই কাকা নামেই।

বাবা  বসকো আইজ্যেকসন  পেশায় ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার  আর মা সিমন ডস সন্তোস পেশায় শিক্ষক। তাদের বসবাস ছিলো ব্রাজিলের গামায়। ১৯৮২ সালের ২২ এপ্রিল  সূর্যের আভার মতো তাদের কোল আলোকিত করে জন্ম নেয় ব্রাজিলের একবিংশ শতাব্দীর রাজপুত্র রিকার্ডো কাকা।

রিকার্ডো কাক : এসি মিলানের অঘোষিত রাজা


এই ছেলেটিই পরবর্তীতেই বনে যাই এসি মিলানের অঘোষিত রাজা। আচ্ছা জানতে ইচ্ছা হয় না, কেমন করে হয়েছিল, রিকার্ডো কাকার উত্থান? কেমন করেই বা মাতিয়েছিলেন ইউরোপিয়ান ফুটবল?

রিকার্ডোর বয়স যখন সাত, তার পরিবার গামা ছেড়ে বসতি গড়ে তোলেন সাও পাওলো তে। সাও পাওলোর স্থানীয় এক স্কুলে ভর্তি হয়  রিকার্ডো। স্কুলের হয়ে ফুটবল খেলা শুরু করে সাত বছরের ছোট ছেলেটি। "আলফাভিল" নামে  স্কুলের যুব ক্লাবটি স্থানীয় একটি টুর্নামেন্টে ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। ফাইনালে প্রতিপক্ষ বারুয়েরি নামের আরেকটি যুবক্লাব।

প্রতিদিনের মতো পানশালায় আড্ডা দিয়ে স্থানীয় দুই ক্লাব আলফাভিল এবং বারুয়েরির ক্ষুদে ফুটবলারদের খেলা দেখতে গিয়েছিলেন সাও পাওলো কোচ পুপো হিমেনেজ এবং তার বন্ধু কার্লোস সানচেজ। মনের সুখে সময় কাটাতে এসে, কাউকে দেখে চোখ আটকে যেতে পারে সেটা বোঝা গেলো  ম্যাচ চলাকালীন সময়ে। দেখলেন, শিশুটি ডান পায়ের প্রথম টাচেই রীতিমত বোকা বানালেন দুই ডিফেন্ডারকে। এরপর হালকা গতি বাড়িয়ে ডিবক্সের বেশ খানিকটা বাইরে থেকে জোরাল শটে নাস্তানাবুদ  করল গোলরক্ষককে। পুপো তার বন্ধু  সানচেজকে বলে বসলেন, ছেলেটা কে? প্রতিউত্তরে সানচেজ জানালো, রিকার্ডো নাম। আর তার পাড়াতেই থাকে। সাথে সাথে পুপো বলে বসলেন, চলো দেখা করি ওর পরিবারের সাথে।

সেদিনই সাও পাওলো কোচ পুপো হিমেনেজ, বন্ধু সানচেজকে নিয়ে হাটলেন রিকার্ডোর বাড়ির উদ্দেশ্যে। মনেমনে সাজিয়ে রাখলেন, কেমন করে কি বলবেন। ব্যপারটা এরকম, ব্রাজিলের অধিকাংশ পরিবারই যেহেতু অর্থনৈতিক দুর্দশার ভেতর দিয়ে যাই, হয়তবা এ পরিবার ও এর বাইরে নয়। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার কথা বললেই হয়তো ছেলেকে যোগ দিতে বলবেন সাও পাওলোতে।

কিন্তু পুপো যা দেখলো, তাতে তার চোখ বাইরে আসার মতো অবস্থা। আলিসান বাড়ি! বাসার সামনে তিনটা গাড়ি। সেইসাথে আছে সুইমিং পুল। তবে পুপোর কথা ফেরালো না রিকার্ডো এবং তার বাবা-মা। সাও পাওলোর যুবদলে খেলার প্রস্তাব দিতেই রাজি হয়ে গেলো। মাত্র  ৮ বছর বয়সেই সুযোগ হলো  সাও পাওলো ক্লাবটির একাডেমিতে খেলার। জার্সির পেছনে ভাইয়ের দেওয়া "কাকা" নামটি জড়িয়ে শুরু হলো নতুন দিনের সূর্যদয় দেখা।

রিকার্ডো কাক : এসি মিলানের অঘোষিত রাজা


প্রায় সাত বছর খেললেন সাও পাওলোর যুব দলে। নিজের সামর্থ্যের সবটুকু প্রমাণ করে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই আনুষ্ঠানিক চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর  করেন কাকা। আনুষ্ঠানিক অভিষেক হয় বছর চারেক পরে।সে মৌসুমে তোর্নেইরো রিও টুর্নামেন্টের ফাইনাল। প্রতিপক্ষ বোটাফোগো। ম্যাচের ৭৬ মিনিট পর্যন্ত ১-০ গোলে পিছিয়ে থাকা সাও পাওলোকে ম্যাচে ফেরালেন বদলি হিসাবে নামা রিকার্ডো কাকা। ৮৩ মিনিটে গোল করে দলকে দিলেন জয়ের সুবাস ম্যাচে ফেরালেন দলকে। ৮৫ মিনিটে আরো এক গোল করে, জয়ই এনে দিলেন রিকার্ডো কাকা।

"উমা প্রিন্সিপা চেগুয়ে" - বাংলা  অর্থ দাঁড়ায়, ‘নতুন এক যুবরাজের আগমন’ - নামে শিরোনাম ছাপলো ব্রাজিলের সংবাদপত্র গ্লোবো স্পোর্তে। পেশাদার ফুটবলে নিজের প্রথম মৌসুমেই ব্রাজিলিয়ান লিগের সেরা ফুটবলার  বনে গেলেন কাকা। ইউরোপিয়ান জায়ান্টরা এরই মাঝে তাকে দলে ভেড়াতে উঠে পড়ে লেগেছে। সাও পাওলোর হয়ে খেললেন দুই মৌসুম। ৫৯ ম্যাচে করলেন ২৩ গোল। ২০০৩ সালে ৮.৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে এসি মিলানে পাড়ি জমালেন।

এসি মিলান (২০০৩-২০০৯)

ইউরোপীয় ফুটবলে তখন  এসি মিলানের জয়জয়কার। দলে আছেন মালদিনি, নেস্তা, রুই কস্তা, ইনজাঘিদের মত তারকারা। একটু আলাদা করেই বলতে হবে রুই কস্তার কথা। সেসময়ে যে কয়জন  মিডফিল্ডারকে বিশ্বসেরা হিসাবে ধরা হতো, তাদের মধ্যে রুই কস্তা অন্যতম। এসি মিলানের মুল একাদশে জায়গা পেতে  তাই শুধুমাত্র  পরিশ্রম নয়, দরকার  ছিল ভাগ্যেরও বিশ্বকাপজয়ী রিকার্ডো কাকার। স্বয়ং ব্রাজিল কোচ স্কোলারি কাকার মুল একাদশে জায়গা পাওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।

রিকার্ডো কাক : এসি মিলানের অঘোষিত রাজা

২০০৩-০৪ মৌসুম

যে রুই কস্তা কে নিয়ে সমর্থকের মনে ভয় জেগেছিল, সে ভয় উড়িয়ে দিয়ে মাত্র মাস খানেকের মধ্যেই মিলানের মুল একাদশে জায়গা করে নেয় রিকার্ডো কাকা। মৌসুমে সিরি'এ আর উয়েফা সুপার কাপ জিতলেও ইন্টারকন্টিনেন্টাল  কাপ আর ইতালিয়ান সুপারকোপাতে রানার্স আপ হয় কাকার এসি মিলান। মৌসুমে ৩০ ম্যাচে  ১০ গোলের সাথে বেশকিছু মুল্যবান অ্যাসিস্ট করে সিরিএ এর সেরা প্লেয়ারের পুরষ্কার জিতে নেয় কাকা।

২০০৪-০৫ মৌসুম

হয়তোবা আজীবন কাকার মনে আচর কেটে যাবে  এ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনাল। প্রথমার্ধে ৩-০ গোলে এগিয়ে মিলান, সবাই যখন উৎসব উৎসব মনোভাবে মোহগ্রস্ত, ৭ম চ্যাম্পিয়নস লিগটা জিতেই গেছে প্রায়।  তখনই গল্পের নতুন মোড়। সবচেয়ে নাটকীয় ফাইনালের সাক্ষী হলো ইস্তাম্বুলের দর্শকেরা। দ্বিতীয়ার্ধে ফিরে এলো অ্যানফিল্ডের রাজারা। আর পেনাল্টি শুট-আউটে জিতল লিভারপুল। কাকার শূন্য চাহনি ছাড়া  ইস্তাম্বুল থেকে আর কিছুই নিয়ে ফেরেনি এসি মিলান। সে মৌসুমে লীগ শিরোপা   ও হারায় মিলান। কাকা ৩৬ ম্যাচে করেন সাত গোল।

২০০৫-০৬ মৌসুম

এসি মিলানের হয়ে এ মৌসুমেও কিছুই জিততে পারেনি রিকার্ডো কাকা। লীগে আবারো রানারআপ হয়েই শেষ করে মিলান। ইউসিএলে বিদায় ঘন্টা বাজে শেষ চার থেকে।

২০০৬-০৭ মৌসুম

এ মৌসুমকে বলা হয়ে থাকে রিকার্ডো কাকার পুরো ক্যারিয়ারের হাইলাইটস। পুরো বিশ্বকে নিজেকে চিনিয়েছেন নতুন করে। এ মৌসুমেই মিলান ছেড়ে শেভচেঙ্কো চেলসিতে  চলে যাই। সেখান থেকে মিলানের মূল পরিকল্পনা কাকাকে নিয়েই  শুরু হয়।


ইস্তাম্বুলের সে রাতের আক্ষেপ ঘোচাই এ মৌসুমে এসে। মিলান জিতে নেয় তাদের সপ্তম চ্যাম্পিয়ন্সলীগ। কাকা জিতে  নেয় সেবছর ইউসিএলের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার। ঠিক কতটা অনবদ্য খেলেছেন তা হয়তো এক বাক্যে বলা যাবে না। সেবার গ্রুপ পর্বে  করলেন নিজের প্রথম  হ্যাটট্রিক। দ্বিতীয় লেগের ৯৩ তম মিনিটে করা তার গোলটি দুই লেগ মিলিয়ে ১-০ গোলে জয় এনে দিয়েছিল সেল্টিকের বিরুদ্ধে চ্যাম্পিয়নসলীগের দ্বিতীয় পর্বে। কাকার ক্যারিয়ার সেরা পারফর্মেন্স ছিলো সেমিফাইনালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে। ঘরের মাঠে ম্যান ইউ ওয়েইন রুনির জোড়া আর রোনালদোর এক গোলে ম্যাচ জেতে ৩-২ এ। কিন্তু মূল্যবান  দুটি অ্যাওয়ে গোল করে এসি মিলানকে কক্ষপথে রাখেন রিকার্ডো কাকা।

দ্বিতীয় গোলের কথা আলাদা করে না বললেই নয়। উঁচু হয়ে আসা বলটা রিসিভ করে দুর্দান্তভাবে নিয়ন্ত্রণে নেন, মাথা দিয়ে আলতো করে সামনে বাড়িয়ে দুই-তিনজন ডিফেন্ডারকে বোকা বানান। সামনে শুধু গোলকিপার! শেষমেশ গোলকিপারকে বোকা বানিয়ে করলেন গোলটা। পরের লেগে ঘরের মাঠে ম্যানইউকে  ৩-০ গোলে নাস্তানাবুদ করে  ফাইনালে চলে যাই কাকার এসি মিলান।

ফাইনালে দেখা হয় স্টিভেন জেরার্ডের লিভারপুলের সাথে।  সেই লিভারপুল যাদের সাথে  প্রথমার্ধে ৩-০ তে এগিয়ে থেকেও হারতে হয়েছিল ট্রাইব্রেকারে। "মিরাকল অব ইস্তাম্বুল" এর সেই  ঘা মিলিয়ে দিতেই যেনো  অ্যাথেন্সের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে নামে  কার্লো আনচেলত্তির এসি মিলান। সেম্যাচে লিভারপুলকে ২-১ এ হারিয়ে এসি মিলান জিতে নেয় সপ্তম বারের মতো চ্যাম্পিয়নসলীগের শিরোপা। কাকা পুরো টুর্নামেন্টে ১০ গোলের সাথে করেন ৫টা অ্যাসিস্ট।  সেবছর ফিফার সেরা খেলোয়াড়, ব্যালন ডি'অরসহ জেতেন বেশ কয়েটা ব্যক্তিগত পুরষ্কার।

এরপর আরো দুই মৌসুম কাটান মিলানের রাডারে। আরো কিছু ঘরোয়া শিরোপা জেতেন। ২০০৭-০৮ মৌসুমের পরে যখন গুজব ওঠে মিলানের ঘরের ছেলে অন্যত্রে পাড়ি জমাবে, তখন সমর্থকেরা  কাকার বাসার সামনে গিয়ে আন্দোলন শুরু করে। পরবর্তীতে কাকা নিজে বের হয়ে দুহাত উচু করে আশ্বস্ত করেছিলেন, তিনি থাকছেন। কোথাও যাচ্ছেন না মিলান ছেড়ে। যদিও মাত্র এক মৌসুম পরেই ২০০৯ সালে ৬৭ মিলিয়ন ইউরোতে পাড়ি জমান রিয়াল মাদ্রিদে।



রিয়াল মাদ্রিদ অধ্যায়ে তেমন কিছুই করতে পারেননি তিনি। সেসময়ে চোট যেনো নিত্য দিনের সঙ্গীতে রুপান্তর হয়ে যাই। রিয়ালের হয়ে ১২০ ম্যাচে মাঠে নামেন। করেন মাত্র ২৯ গোল। মাত্র ১টি লা লিগা, ১টি কোপা দেল রে আর ১টি স্প্যানিশ সুপার কাপ ছাড়া জেতেননি আর কিছুই। ২০১৩ সালে আবারো মিলানে ফেরেন। কিন্তু করতে পারেননি কিছুই। দেখা মেলেনি সেই দুর্দান্ত কাকার। এরপরে পাড়ি জমান  মেজর লীগ সকারে। ততদিনে অবশ্য রিকার্ডো কাকা নামের জাদুকর এক আক্ষেপ বনে যায় ।