কি ভাবছেন? হবে হয়তো লেগানেস বা সেভিয়ার মতো কোন একটা দল। না! না! দলটার নাম বার্সেলোনা। হয়তো মনে মনে বলেই ফেলেছেন - কি.....বার্সা!এখনকার সময়ের অনেকেরই হয়তো চিন্তার বাইরে।কিন্তু সেসময় তরুনদের জন্য বার্সা কোন আদর্শ জায়গা ছিল না।
এর কিছুদিন বাদেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ঘোষণা হলো , লাপোরতো নামের চল্লিশ বছর বয়সী একজন আইনজীবী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। লাপোরতোর প্যানেল জিতলে ক্লাবে নিয়ে আসবেন ডেভিড বেকহ্যামকে। বর্তমান সময়ে মেসি-রোনালদোর জনপ্রিয়তা যেমন তুঙ্গে, ঠিক তেমনটা ছিল সেসময়ে ডেভিড বেকহ্যামের ক্ষেত্রে।তারচেয়ে বড় কথা , বেকহ্যামের মতো এক নেতার অভাবে পুড়ছিল বার্সা।
নির্বাচনে জিতে গেলো লাপোরতোর প্যানেল। কিন্তু মাত্র তিন দিন পরে সবথেকে বড় দুঃসংবাদ পেলেন প্রেসিডেন্ট লাপোরতো।ডেভিড বেকহ্যাম যাচ্ছেন রিয়াল মাদ্রিদে।এমন সময় কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না প্রেসিডেন্ট লাপোরতো। এদিকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ডেভিড বেকহ্যামের রিপ্লেসমেন্ট হিসাবে ব্রাজিলের উঠতি তারকা পিএসজির রোনালদিনহোর পিছে ছুটেছে। পরে অবশ্য বার্সার বোর্ড সহ-সভাপতি স্যান্দ্রো রোজেলের ব্রাজিলের ফুটবল এজেন্টদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকায় সেসব লিঙ্ক ধরে রোনালদিনহোকে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। অতঃপর ২০০৩-০৪ মৌসুমে ক্যাম্প ন্যু তে পাড়ি জমান রোনালদিনহো। কিন্তু অনেকেই শঙ্কাগ্রস্ত ছিল তরুন রোনালদিনহোর হাতধরে বার্সা কতদূর এগোবে যদিও ততদিনে ব্রাজিলের জার্সি গায়ে জাদু দেখানো শুরু করে দিয়েছেন রোনালদিনহো। রোনালদো, রিভালদোকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন "3R" নামে এক ত্রয়ী। ২০০২ এর বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন ব্রাজিলকে। তারপরেও শঙ্কা থাকেই , একটা অগোছালো দলকে নিয়ে কতদূরই বা যেতে পারবে?
২০০৩-০৪ মৌসুম
হয়তো নামটা রোনালদিনহো বলেই , বার্সেলোনা তে মানিয়ে নিতে সময় নেয়নি একেবারেই। নিজের অভিষেক ম্যাচে পায়ের জাদু দেখিয়েছেন রোনালদিনহো। সেভিয়ার সাথে সে ম্যাচে দুই প্লেয়ারকে কাটিয়ে ডি-বক্সের বাইরে থেকে শটে যে গোলটা করলেন তা দেখেই ক্যাম্প ন্যু এর সমর্থকেরা দিনহোকে ঘরের ছেলে মেনে নিয়েছিলেন। সে ম্যাচের রেশ কাটতে না কাটতেই দিনহো পড়লেন ইন্জুরীতে।
ইন্জুরী থেকে যখন আবার ফিরলেন তখন বার্সার অবস্থা অনেকটাই নাজেহাল।লীগে বার্সার অবস্থান ১২ তম। যখন ফিরলেন তখন আবার শুরু হলো রোনালদিনহো ম্যাজিক। ১২ নাম্বার থেকে লীগ শেষ হলো রানারআপ হয়ে। মৌসুম শেষে দিনহোর গোল সংখ্যা ১৫ আর অ্যাসিস্ট ১২।
২০০৪-০৫ মৌসুম
রোনালদিনহোর পায়ের জাদুতে একটু একটু করে ঘুরে দাড়াতে শুরু করেছে বার্সা। সে মৌসুমে ডেকো আর ইতোকে সাথে নিয়ে গড়ে তুলেছেন নতুন আক্রমনভাগ। মৌসুম শেষে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদকে চার পয়েন্টের ব্যবধানে হরিয়ে লালীগার শিরোপা জিতেছে বার্সা। চল্লিশটির ও বেশী গোলে অবদান রেখেছে রোনালদিনহো।ছয় বছর পরে লীগ জয়ে রোনালদিনহোর অবদান বুঝাতে তারই সতীর্থ ডেকো বলেন," অনেক সময় আমাদের কোনো ধারণাও ছিলনা যে, প্রতিপক্ষ ডিফেন্স কিভাবে ভাঙব। রোনালদিনহো ঠিকই উপায় বের করে ফেলতেন। এটা ট্যাকটিক্স বা গেমপ্ল্যানের অংশ না, এটা তাঁর সহজাত খেলা।”
২০০৫-০৬ মৌসুম
রোনালদিনহোর ক্যারিয়ারের সেরা মৌসুম বলা হয়ে থাকে এ মৌসুমকে। পায়ের ভেল্কিতে বিপক্ষ দলের জালে ২৬ বার বল জড়িয়েছেন রোনালদিনহো। চ্যাম্পিয়ন্সলীগে খেলেছেন জাদুকরী খেলা।রাউন্ড অফ সিক্সটিনে চেলসির বিরুদ্ধে করেছেন মনোমুগ্ধকর এক গোল। কোয়ার্টার ফাইনালে বেনফিকাকে হারানো দুইগোলের একটি তার বানিয়ে দেওয়া। সেমিফাইনালে মিলানকে হারানো একমাত্র গোল ও দিনহোর দেওয়া। আর ফাইনালে আর্সেনালের বিরুদ্ধ ২-১ গোলের জয় বার্সাকে ১৪ বছর পর ইউরোপ সেরার আসনে বসিয়ে দেয়।
সেমৌসুমে লালীগায় রিয়াল মাদ্রিদের সাথে করা ২য় গোলের পরেতো বার্নাব্যুর সমর্থকেরা দাড়িয়ে অভিভাদন জানিয়েছিলেন। অথচ শুধুমাত্র কালো বলেই ব্রান্ড ডোবাতে পারে বলে দলে নিতে চাইনি রিয়াল মাদ্রিদ। মৌসুম শেষে আবারো লীগ জিতে নেয় বার্সা।যে দলটা ছিল খাদের কিনারায়। সে দলটাই রোনালদিনহোর আগমনে বদলে যায়।বার্সা জিতে নেয় টানা ২ লীগ আর ১৪ বছরের প্রতিক্ষার অবসান ঘটা এক চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শিরোপা।
২০০৬-০৭ মৌসুম
দিনহোর পায়ের ভেল্কি এ মৌসুমেও লালীগা তে চলতে থাকে।লীগে নিজের সর্বোচ্চ ২১ গোল করেন এ মৌসুমে। লালীগা ডিসাইডারে বার্সার পয়েন্ট সমান সমান থাকলেও হেড টু হেডের লড়াইতে রিয়ালের কাছে শিরোপা হারায় দিনহোর বার্সেলোনা।
পরের মৌসুমে তেমন কিছুই করতে পারেননি দিনহো। অতিরিক্ত মাদকাসক্তি আর ইন্জুরী তার খেলায় ছাপ পড়তে শুরু করেছে।মৌসুম শেষে তার নতুন ঠিকানা হয় এসি মিলানের রাডারে। যে রোনালদিনহোর হয়ে ওঠার কথা ছিল বার্সার রাজা , তার বার্সা অধ্যায় ই শেষ হয়ে গেলো মাত্র ২৭ বছর বয়সে।
আজকের দিনের লিওনেল মেসির অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল তার সময়েই।বার্সার হয়ে মেসির করা প্রথম গোলটা তো রোনালদিনহোর ই বানিয়ে দেওয়া। মেসি বলেন , "১৬ বছর বয়সে বার্সা ড্রেসিংরুমে আসাটা সহজ কোনো ব্যাপার নয়। তবে রোনালদিনহো আমার জন্য পরিবেশটা সহজ করে দিয়েছিলেন।” সেসময়ে মেসির যত্ন নিয়েছেন পরম ভালোবাসায়।একাডেমীতে প্রথম যেবার মেসির খেলা দেখতে গিয়েছিলেন, সদ্য ব্যালন ডি'অর জেতা দিনহো বলেই দিলেন, " বার্সারই সেরা প্লেয়ার তিনি নন,বার্সার সেরা প্লেয়ার একাডেমীতে খেলে।”
ডেভিড বেকহ্যামকে না পাওয়ার ব্যর্থতায় , তিনি যখন ক্লাবে এসেছিলেন তখন কে বা জানতো , এই ছেলে একদিন বার্সার হয়ে বিশ্বশাসন করবে। তাকে ঘিরে আক্ষেপের ও শেষ নেই! মাত্র ২৭ বছর বয়সে বার্সা অধ্যায় শেষ হয় তার। অতিরিক্ত মদ্যপান তার ক্যারিয়ার ফেলে দিয়েছিল হুমকীতে।হয়তো ফিট থাকলে হতে পারতেন গ্রেটেস্টদের গ্রেটেস্ট, ওয়ান অফ দ্যা গ্রেটেস্ট।এসবকে কখনোই কেয়ার করেন না দিনহো।তিনি পায়ের জাদুতে মাতিয়েছেন বিশ্ব ফুটবল।খেয়ালী মনে করেছেন একের পর এক রেকর্ড!হয়তো খেয়ালী রাজা বলেই কোন পরিসংখ্যান মানেন না। হয়তো কোন একদিন মৃদু হেসেই বলে ফেলবেন , ডেভিড বেকহ্যাম এমন কিবা করেছিল রিয়ালের হয়ে। না! তিনি বলবেন না।এসব পরিসংখ্যান তিনি কখনোই মানেন না কারন তিনি এক খেয়ালী রাজা।
0 Comments
Post a Comment